যাদের ত্যাগ আর জীবনের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পেয়েছে একটি স্বাধীন দেশ, জাতীয় পতাকা এবং আত্মপরিচয়। সেই বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হলো এদেশের মুক্তিযোদ্ধারা। যদি কোন মুক্তিযোদ্ধা এই স্বাধীন দেশে অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে দিনে দিনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তা ভাবতে শুধু অবাক লাগে না, বুকে বিদ্ধ হয় বুলেট, তথা চরম মৃত্যু যন্ত্রণা।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু পথযাত্রীতে পরিণত হয়েছে। তার বাড়ি নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কাশিরাম ইউনিয়নের বাগিচাপাড়ায়। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় তিনি শ্রমিক হিসাবে চাকরি করে বছর তিনেক আগে অবসরে গেছেন। তিন ছেলে, পাঁচ মেয়ে, স্বামী স্ত্রী মিলে ১০ জনের সংসার।

চাকরি জীবনে যা আয় করেছেন তা ১০ জন মানুষের মুখের আহার জোটাতেই শেষ হয়েছে। অবসরে যাওয়ার পর গ্রাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, কল্যাণ তহবিল মিলে যা পেয়েছেন তাই দিয়ে গড়ে তুলেছেন সন্তানদের নিদ্রাযাপনের ঠিকানা। আবাদি জমি বলতে রয়েছে মাত্র ৯০ শতক। তাও আবার এক ফসলি। প্রায় আড়াই বছর আগে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। জীবন বাঁচাতে শুরু করেন চিকিৎসা। দূরারোগ্য চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে ওই আবাদি জমিটুকুও বন্ধক দেয়া হয়েছে। হাতে নগদ যা সামান্য ছিল তাও নিঃশেষ হয়েছে। বর্তমানে চাকরির পেনশন আর মুক্তিযোদ্ধার ভাতার ওপর ভরসা করে চলতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়।

এজন্য ঋণের দায় মেটাতে ভাতার অর্ধেক চলে যায়। ফলে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নানের বর্তমান মাসিক আয় সব মিলে ১৪ হাজার ৫০০ টাকা। ছেলে মেয়েদের মধ্যে পাঁচ মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তিন ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে মিনারুল পুলিশের সেপাই পদে চাকরি করে অন্যত্র বাস করে। বড় ও মেজ ছেলে আনোয়ারুল ইসলাম ও আদর রহমান পুরোপুরি বেকার। এরাও আবার বিবাহিত। এদের প্রত্যেকের তিনটি করে সন্তান রয়েছে। অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা বাবার আয়ের ওপর তারাও নির্ভরশীল। ফলে পরিবারের বর্তমান লোকসংখ্যা ১০ জন। বর্তমান আকাশচুম্বি বাজারে ১০ জনের সংসারে সাড়ে ১৪ হাজার টাকা দিয়ে মাসের ১৫ দিনেও খাওয়া খরচ চালানো অসম্ভব। এছাড়াও পরিবারের ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার ব্যয় রয়েছে। এমন অবস্থায় ১০ জন মানুষের আহার মেটাবে, না চিকিৎসা করবে তা ভেবে কুল কিনারা মিলে না। এমন অবস্থায় ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

কথা হয় তার বড় ছেলে আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন চাকরির জন্য অনেক দেনদরবার করেছি, কিন্তু টাকার অভাবে চাকরি জোটেনি। এমন অবস্থা তার মেজ ভাই আদর রহমানেরও। বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে তারা দুই ভাই বাবার আয়ের ওপর স্ত্রী সন্তান নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নানের স্ত্রী জোসনা বেগম বলেন আমার স্বামী ১৯৭১ সালে নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল। নীলফামারী সদর উপজেলার চড়াইখোলা উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি পড়াশোনা করতেন। ভাল ছাত্র হিসাবে বেশ নামডাক ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঐতিাসিক সাত মার্চের ভাষণ শুনে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। জীবনের বিনিময়ে হলেও দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করার দৃঢ় শপথ হৃদয়ে ধারণ করে।

মে মাসের শেষে চিলাহাটি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। ভারতে প্রবেশ করার পর মুক্তিযোদ্ধার ক্যাম্প খুঁজতে থাকে। অবশেষে খোঁজ পায় দার্জিলিং মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের। সেখানে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখায়। এরপর এক মাস ট্রেনিং শেষে শপথ নেয়। শপথ বাক্য পাঠ অনুষ্ঠানে শেখ হামাল ও শেখ ফজলুল হক মনি উপস্থিত ছিলেন। এরপর চিলাহাটির হিমকুমারীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে চলে আসে। সেখান থেকে ক্যাপ্টেন আবুল বাশারের নেতৃত্বে ডোমার উপজেলার হলদিবাড়ী, চিকনমাটি এলাকায় যুদ্ধ করে। দুঃসাহসি হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে মেশিনগান চালাতেন। ডোমার উপজেলা হানাদার মুক্ত হলে পরে সেখান থেকে চলে যায় জলঢাকায়। টেংগনমারী এলাকায় জলঢাকা থেকে অপারেশনে অংশ নেয়। টেংগনমারী মুক্ত হলে ১৪ ডিসেম্বর প্রচন্ড লড়াই হয় পাকি সেনাদের সঙ্গে কিশোরগঞ্জে। এদিনই কিশোরগঞ্জ এলাকা মুক্ত হলে পরে নীলফামারী শহরের আশপাশ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা জড়ো হতে থাকে। তারা সৈয়দপুরমুক্ত করতে প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিন্তু অপর্যাপ্ত অস্ত্র ও গোলা বারুদ না থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা সৈয়দপুর আক্রমণে সাহস পায় না।

এদিকে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাধ্যক্ষ জেনারেল নিয়াজী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলেও সৈয়দপুর শহর তখনও হানাদারমুক্ত হয়নি। ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সৈয়দপুর সেনানিবাসে পাকি সেনা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রস্তুতি নিতে থাকে। এর কারণটি হলো দেশের বৃহৎ রেলওয়ে কারখানা থাকায় ৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ভারতের বিহার থেকে আসা রেলওয়ের শ্রমিকরা সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় যোগ দেয়। সে কারণে দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে সৈয়দপুর শহরে উর্দুভাষী বিহারীদের সংখ্যা অনেক বেশি। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন লালমনিরহাট, কাউনিয়া, বোনারপাড়া, পার্বতীপুর, সান্তাহার, দিনাজপুর ও রাজশাহী থেকে বিতাড়িত উর্দুভাষী বিহারীরা সৈয়দপুরে অবস্থান নেয়। পাকিস্তান সমর্থকদের সংখ্যা অনেক বেশি সৈয়দপুরে। সেজন্য পাকি সেনারা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ় মনোবলে আগুয়ান হওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এজন্য তারা সৈয়দপুরে বিমানবন্দরও তৈরী করে। সব মিলিয়ে সৈয়দপুর সেনানিবাসে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মত সে সময় প্রচুর রসদ মজুদ ছিল। এমন পরিস্থিতিতে মুক্তির নেশায় ১৮ ডিসেম্বর সৈয়দপুরের মুক্তিযোদ্ধারা চিলাহাটির হিমকুমারী ক্যাম্পের সহায়তায় ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে পূর্ণ সামরিক অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সৈয়দপুরের চারদিক দিয়ে সাধারণ জনগণকে নিয়ে শহরে প্রবেশ করে। এরপর পৌরসভা ও থানায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এদিনও উর্দুভাষী বিহারীদের ছোড়া গ্রেনেডের আঘাতে মারা যান মোবারক আলী নামক এক ব্যক্তি।

মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান জানান, দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান তাদের সঙ্গে অংশ নিয়ে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি যুদ্ধের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন। অসিম সাহসী ওই যোদ্ধা মেশিন গান, স্টেনগান ও গ্রেনেড ছুড়তে সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন। কোন কিছুকেই পরোয়া না করেই শুধুমাত্র দেশকে স্বাধীন করতে তিনি ছিলেন সবসময় অবিচল। যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক সময় না খেয়ে থেকেও পিছু হটেনি। কমান্ডের নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাকে দায়িত্ব দেয়া হলে সঠিক ও সুচারুভাবে পালন করে তবেই ক্যাম্পে ফিরে আসতো। কোন সময় কোন ধরনের লোভ তাকে ছুতে পারেনি। দেশপ্রেম আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তার শিরা উপশিরায় প্রতি মুহূর্তে বহমান। আওয়ামী লীগের চরম দুঃসময়ে সে আদর্শচ্যুত হয়নি। আওয়ামী লীগের ডাকা প্রতিটি সংগ্রামে নিজ মনের তাগিদে অংশ নিয়েছে। কোনদিন কোন নেতাকে তাগিদ দিয়ে বলেনি তাকে দলের সদস্যপদ দেয়ার। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি সম্বলিত নৌকা মার্কা তার হৃদয়ের স্পন্দন। সব জাতীয় নির্বাচনে নৌকা মার্কার পক্ষে সাধ্যমত নিজ অর্থ ব্যয়ে প্রচার প্রচারণায় অংশ নিতেন। তারই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে তার সন্তানরাও।

কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নানের বড় ছেলে আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন বাবার পথ অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করেছি আমরাও। কোনদিন দলের নেতাদের কাছে বাড়তি কিছুই চাইনি। চরম অভাব অনটনে থেকেও আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে আছি। তবে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন আমার বাবা নিজের জীবন তুচ্ছ করে দেশকে স্বাধীন করতে মুক্তিযুদ্ধে ছোট বয়সে অংশ নিয়ে যুদ্ধ করেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক সম্মুখ যুদ্ধে তার বাবা অংশ নেয়। সেদিন হয়তো মৃত্যু হতো। কিন্তু অলৌকিকতায় প্রাণে বেঁচে গেছে। অথচ এই স্বাধীন দেশে টাকার অভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা হচ্ছে না।

আনোয়ারুল ইসলাম আরো জানান, ঢাকায় ক্যান্সার চিকিৎসকরা বেশ কয়েক মাস আগেও উন্নত চিকিৎসার জন্য বাবাকে ভারতে নিয়ে যেতে বলেছিল। এজন্য কমপক্ষে ১০ লাখ টাকার প্রয়োজন। আমাদের মতো গরীব পরিবারের পক্ষে এতো বড় অংকের টাকার যোগান দেয়া মোটেই সম্ভব নয়। ফলে বাবা প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে দিন দিন মৃত্যুর মুখে ধাবিত হচ্ছে। আমরা বেকার দুই ছেলেও বাবার চিকিৎসার কোনভাবেই অর্থ যোগদান দেয়ার মতো আমাদের সামর্থ্য নেই। তার মতে, আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে সব সময় বদ্ধ পরিকর ছিল। আজ জীবনের শেষ বেলায় এসে অর্থের অভাবে তা আমরা তার চিকিৎসা করাতে পারছি না। এজন্য তার বাবাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করার ব্যয়ভার মেটানোর জন্য বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর যোগ্য কন্যার সদয় দৃষ্টি তিনি কামনা করেছেন। (ছবি আছে)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।