মসলেম আলীর স্ত্রীর নাম বুড়ি বিবি। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করেছিলেন। একইভাবে বাবার বকুনি খেয়ে আত্মহত্যা করেন মসলেম আলীর ছোট ভাই ইসলাম আলী। তাঁর বোন আকলিমা খাতুনও মায়ের সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যা করেন। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এসব ঘটনা ঘটে। দুই সন্তান ও পুত্রবধূর আত্মহত্যার ঘটনায় অনেকটা বাকরুদ্ধ মসলেম আলীর বাবা আবুল হোসেন। স্ত্রী ও দুই ভাইবোনের আত্মহত্যায় হতবিহ্বল মসলেম আলী বলেন, তিন সদস্যের মৃত্যুর পর গোটা পরিবার অনেকটা এলোমেলো হয়ে পড়েছিল। তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে অনেক সময় কেটে গেছে।

মসলেমের পরিবার শুধু নয়, এ সমস্যা ঝিনাইদহ জেলার অনেক পরিবারে। জেলায় এমন কিছু পরিবার রয়েছে, যেখানে তিন-চার সদস্য আত্মহত্যা করেছেন। মসলেমদের বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার চাপালী গ্রামে। ওই গ্রামের শওকত আলী, আমজাদ আলী, চাঁদ আলী, শহিদুল ইসলাম, ফুদি বেগমসহ বেশ কয়েকজন আত্মহত্যা করেছেন।

আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান এবং এই নেতিবাচক তৎপরতা বন্ধের কাজে নিয়োজিত একটি বেসরকারি সংস্থা জানায়, আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি না হওয়া, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, কীটনাশকের সহজপ্রাপ্যতা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ, বিষণ্নতা, প্রেম, বাল্যবিবাহসহ নানা কারণে এই জেলার মানুষ আত্মহত্যা করছে। জেলা সিভিল সার্জন ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের বরাত দিয়ে সোভা নামের ওই সংস্থা জানায়, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর এ জেলায় প্রতিদিন গড়ে একজন করে মানুষ আত্মহত্যা করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহ জেলা একটি আত্মহত্যাপ্রবণ এলাকা।

এই জেলায় আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করছে সোসাইটি ফর ভলান্টারি অ্যাকটিভিটিস (সোভা)। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক জাহিদুল ইসলাম জানান, ঝিনাইদহ আত্মহত্যাপ্রবণ একটি জেলা। এ এলাকার মানুষ কীটনাশক পান অথবা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। সোভার হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে জেলায় আত্মহত্যা করেছে ১ হাজার ৮৭০ জন। আর আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে ১২ হাজার ৫৩৬ জন, যাদের বেশির ভাগ নারী। হিসাব অনুযায়ী জেলায় প্রতিদিন গড়ে একজন করে আত্মহত্যা করেছে।

সোভার নির্বাহী পরিচালক মনে করেন, সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে গোটা জেলায় আত্মহত্যার হার কমিয়ে আনা সম্ভব। একাধিক সদস্য আত্মহত্যা করেছেন, এমন কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ আত্মহত্যাই পারিবারিক কলহের কারণে।

এ বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলার মসলেম আলী বলেন, তাঁর বাবা আবুল হোসেন কিছুটা রাগী মানুষ ছিলেন। তাঁর দুই ভাইবোন মারা গেছেন মা-বাবার সঙ্গে ঝগড়ার জের ধরে। তিনি বলেন, ‘যেসব কারণে তারা আত্মহত্যা করেছে, তা জীবন দিয়ে দেওয়ার মতো কোনো ঘটনা না। তারপরও আমাদের এলাকার মানুষের মন একটু নরম প্রকৃতির হওয়ায় ছোট বিষয়ে তারা জীবন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে।’

কালীগঞ্জ উপজেলার চাপালী গ্রামের আরিফুর রহমান জানান, তাঁর এক ভাই ইব্রাহিম হোসেন গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। তাঁর এক চাচা কওছার আলীও গলায় ফাঁস দিয়ে মারা যান। তাঁর আরেক চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রীও আত্মহত্যা করেন। এসব আত্মহত্যা পরিবারকে তছনছ করে দিয়েছে।

ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন সেলিনা বেগম বলেন, ‘এই জেলায় যারা আত্মহত্যা করে, তাদের অধিকাংশই নারী। এরা কেন আত্মহত্যা করে, তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, বেশির ভাগ নারী নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হন। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে তাঁদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তাহলে নির্যাতন কমবে, আর নির্যাতন কমলে আত্মহত্যা কমবে।

ঝিনাইদহের প্রবীণ শিক্ষাবিদ এম এন শাহজালাল বলেন, ‘এই অঞ্চলে তেমন শিল্পকারখানা নেই। যে কারণে বেকারত্ব রয়েছে। বেকারদের জীবনযাপনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পার করতে হয়। তখনই বিষণ্নতা দেখা দেয়। দারিদ্র্য ও সংসারে তীব্র অভাবের কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ ছাড়া বাল্যবিবাহের কারণেও পারিবারিক অশান্তি দেখা দেয়। অল্প বয়সে বিয়ে দিলে অল্পদিনেই পরিবারে গোলমাল দেখা দেয়। সেটাও আত্মহত্যার একটা কারণ। এ ছাড়া মাদকাসক্তির কারণে আমাদের এই অঞ্চলে অনেকে আত্মহত্যা করছে।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।