বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও উৎপাদন খরচের চেয়ে দাম কম পেয়েছেন কৃষক। তাই সার-বীজ-কীটনাশকের বকেয়া ঋণ পরিশোধ করতে গোয়ালের গরু-ছাগল বিক্রি করছেন অনেকেই। ধানের দামের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সামর্থ্যবান গৃহস্তেরও ঘরে। সব মিলিয়ে জ্যৈষ্ঠের শুরু থেকেই চরম অর্থকষ্ট চলছিল গ্রামীণ জনপদ জুড়ে। তবে ঈদের আগমুহূর্তে শহরে চাকরিজীবী স্বজনদের বেতন-বোনাস ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে বেশখানিকটা স্বচ্ছলতা ফিরেছে গ্রামে। এর ওপর দীর্ঘদিন পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নাড়ির টানে স্বজনরা ঘরে ফেরায় সুখের হাসি ফুটেছে কৃষকের ম্স্নান মুখে।

এদিকে রোজা শুরুর পর থেকে গ্রামীণ জনপদের হাট-বাজার ও মার্কেটসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বেচাকেনায় চরম মন্দাভাব দেখা দিলেও সে কালো মেঘ যেন কেটে গেছে হঠাৎ দমকা ঝড়ে। শহুরে চাকরিজীবীরা গ্রামে ফিরে বাবা-মা-ভাই-বোনদের পাশাপাশি নিকটাত্মীয়-স্বজনদের জন্য জামা-কাপড়-শাড়ি-জুতাসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ ও নানা ব্যবহার্য সামগ্রী কিনতে শুরু করায় ভিড় বেড়েছে সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এতে মন্দার আশঙ্কায় গুটিয়ে থাকা ব্যবসায়ীদের মুখেও ফিরেছে সন্তুষ্টির হাসি।

এদিকে ঋণের টাকা শুধতে কম দামে ধান বেচে দেয়ার জন্য মুখিয়ে থাকা অনেক কৃষকই শহর থেকে ঘরে ফেরা চাকরিজীবী সন্তানদের কাছ থেকে নগদ টাকা পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। ঈদের বাড়তি বাজেট কিছুটা কাঁটছাঁট করে তারা অনেকেই সুদী মহাজনের ঋণের টাকা শুধেছেন। এতে ঋণের বোঝার বিশাল চাপ কমেছে অনেকের।

কৃষকরা জানান, ধানের উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় আর্থিক কষ্ট তাদের রয়েই গেছে। তবে তা খানিক চাপা রেখেই স্বজনদের নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চাইছেন অনেকেই। চাকরিজীবী সন্তানদের কাছ থেকে পাওয়া নগদ টাকায় মহাজনের ঋণ কিছুটা শুধতে পারায় তারা এখন বেশখানিকটা ফুরফুরে। কেননা ঈদের পর সরকারের ঘরে ন্যায্যমূল্যে ধান বিক্রির সুযোগ পাবে- অনেকের মাঝেই এখন এ আশা জেগেছে।

মানুষের ভিড় গ্রামে যতই বাড়ছে, ততই প্রাণ ফিরে পাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এছাড়া ঈদে ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠানের কারণে গ্রামে অর্থের প্রবাহ বেড়েছে অনেক বেশি। জাকাত ও ফেতরার বড় অংশ বিতরণ হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে। যা গ্রামের মানুষের জন্য ইতিবাচক হয়ে ধরা দিয়েছে।

এদিকে বছর ঘুরে ঈদে ছেলে-ছেলের বউ, নাতি-নাতনি আসার পর তাদের পছন্দের কোন খাবার রান্না এবং শহরে ফেরার সময় চিড়া-মুড়ি-নাড়ু সঙ্গে দিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি চলছে যেনো গোটা গ্রামীণ জনপদ জুড়ে। এর সঙ্গে চলছে ঈদের প্রস্তুতি। তাই প্রতিটি ঘরেই কর্মচাঞ্চল্য, অবসর নেই কারো। তবে এসব কাজে যেন কারো কোনো কষ্ট নেই, নেই কোনো ক্লান্তি। ছোট-বড় সবার কাছেই এসব কর্মচাঞ্চল্য যেন ধরা দিয়েছে আনন্দ উৎসবের অংশ হয়েই। ঈদের ছুটিতে ক’দিন আগেই যারা ঘরে ফিরেছেন তাদেরও অবসর নেই। ঈদের ছুটি ক’দিন পরই ফুরিয়ে যাবে, আবারও ফিরে যেতে হবে সেই ইট-পাথরে গড়া পাষাণ নগরে। তাই এরই মাঝে পাওয়া সময়ের একটি মুহূর্তও নষ্ট করতে চায় না শহর থেকে ফেরা মানুষ। ভোর না হতেই তাই কেউ বা ছুটছে দূর গ্রামে থাকা নিকটাত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি। হাতে রয়েছে তাদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের জন্য শহর থেকে আনা ঈদ উপহার। আর এসব হাতে পেয়ে বাঁধভাঙা আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।

একই গ্রামের বাসিন্দা ঢাকার মালিবাগের গার্মেন্টের কর্মী শেফালি জানান, ঈদ খরচার জন্য ছয় মাস ধরে বেতনের টাকা থেকে ৫/৭ শ’ করে টাকা জমিয়েছিলেন। সে টাকা দিয়ে মায়ের জন্য শাড়ি, বাবার জন্য লুঙ্গি-পাঞ্জাবি এবং দু’বছরের ভাতিজার জন্য ২০০ টাকা দিয়ে খেলনা কিনে এনেছেন। নিজের জন্যও কিনেছেন বালুচুড়ি শাড়ি। শেফালি জানান, কিছু না নিয়ে এলেও বাবা-মা-ভাইবোনেরা খুশি। তারপরও ঈদের সময় তাদের জন্য কিছু না আনলে ভাল লাগে না। তাই কষ্টের জমানো টাকায় এসব কিনে এনেছেন। ছুটির এ ক’দিন পরিবারের সবার সঙ্গে কতটা আনন্দে দিন কাটবে তা বলতে গিয়ে আনন্দ অশ্রম্ন এসে যায় আলেয়ার দু’চোখে।

আমাদের রাজশাহীর তানোর সংবাদদাতা আসাদুজ্জামান মিঠু জানান, গত ক’দিন ধরেই গোটা গ্রামে বয়ে যাচ্ছে ঈদের আগাম আনন্দ। নিখাদ এ আনন্দের ঝলকানিতে রাতের আঁধারেও ফুটেছে রঙ্গিন আলো। ৩১ মে বৃহস্পতিবার কর্মদিবস শেষ করেই গ্রামে ফিরেছেন শহুরে চাকরিজীবীরা অনেকেই। এদের অনেকে আবার আগেই পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

গোদাগাড়ীর কাকন হাট পৌর এলাকার সামসুজ্জামান চৌধুরী সরকারি চাকরিজীবি। কর্মস্থল চট্টগ্রামে। তিনিও ৩১ মে কর্মদিবস শেষ করে পরিবার নিয়ে পহেলা জুন গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। তিনি জানান, এবারের ঈদের লম্বা ছুটির সঙ্গে আরো দুইদিনের বাড়তি ছুটি নিয়েছেন। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার প্রত্যাশা এ সরকারি কর্মকর্তার।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।