নিজস্ব সংবাদদাতা, ঢাকা; করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে অধিকাংশ দেশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। পাশের পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়ার পরও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ না করায় অভিভাবক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। গতকাল দুপুরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিন রোগী সুস্থ্য হয়ে দুইজন বাসায় ফেরার পর দেশে আর কোন করোনা রোগী নেই বলে ঘোষণা দেয়া হলেও রাতেই ধরা পরে আরও দুই জনের শরীরে করোনা ভাইরাস।গতকাল শনিবার (১৪ মার্চ ২০২০) রাত সাড়ে নয়টার দিকে রাজধানীর মিন্টো রোডে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক তথ‌্য জানান।

আতঙ্কে অনেক অভিভাবক ইতিমধ্যে নিজ উদ্যোগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। এ কারণে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমে যাচ্ছে। অভিভাবকরা বলছেন, স্কুল-কলেজগুলো বন্ধ না করে সরকার এখন কী দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ার পর বন্ধ করা হবে?

তারা বলছেন, কোনো স্কুলে যদি করোনা আক্রান্ত একজনকেও পাওয়া যায় তাহলে কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে স্কুলের প্রায় সবাইকে। ছোটো ছোটো শিশুদের কীভাবে কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হবে। তারা কী বাবা-মা ছাড়া একা থাকতে রাজি হবে। হোম কোয়ারেন্টাইনও কি শিশুদের দিয়ে সম্ভব হবে?

সরকার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে স্কুল বন্ধ না করে অ্যাসেম্বলি মাঠে না করে শ্রেণিকক্ষে আয়োজনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটি সচেতনতামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে। এমন বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও।

অভিভাবকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের রোগ প্রতিরোধে জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে স্কুলের চেয়ে জনসমাগম আর কোথায় বেশি হয়। স্কুলে প্রবেশ এবং ছুটি হবার সময় বের হতে গিয়ে স্কুলের ছোটো গেট দিয়ে একে অপরের সংস্পর্শে সবচেয়ে বেশি আসে। ছোট্ট একটি ক্লাসরুমে ৭০ থেকে ৯০ জন শিক্ষার্থী চার-পাঁচ ঘণ্টা অবস্থান করে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমে একটি বেঞ্চে চার-পাঁচ বা ছয় জন পর্যন্ত গাদাগাদি করে বসে। ফলে কোনো শিক্ষার্থী ভাইরাসের সংক্রমণ হলে তা অন্য শিক্ষার্থীর মধ্যে ছড়নোর আশঙ্কা থাকে।

স্কুল ছাড়াও আতঙ্কে রয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। তারা গণপরিবহনে চড়ে আসে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকায় স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা পালন করা শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আবাসিক হলে প্রতিটি কক্ষে চার-পাঁচ জন করে থাকে । গণরুমে থাকে ৩০ থেকে ৪০ জন। ফলে একজন অসুস্থ হয়ে পড়লেও অন্য সবার অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

এদিকে বিদেশফেরত দুই জন শিক্ষক কোয়ারেন্টাইন ছাড়াই কাজে ফেরায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়টির পাঁচটি আবাসিক হল ও একাডেমিক ভবনগুলোতে কোনো হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা হ্যান্ডওয়াশের ব্যবস্থা নেই। হলগুলোয় একই রুমে গাদাগাদি করে থাকছেন শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া সচেতনতা তৈরিতেও কোনো টাস্কফোর্স বা কমিটি করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন  বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে করোনাভাইরাস থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের নিরাপদে রাখতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছে। শিক্ষকদের মাধ্যমে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। আতঙ্ক না ছড়িয়ে সবাইকে সচেতন করে তুলতে শিক্ষকদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যেহেতু এখনও জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি, তেমন পরিস্থিতি হলে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হবে। শিক্ষার্থীদের কীভাবে আরও বেশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়েও চিন্তাভাবনা চলছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের এক অতিরিক্ত সচিব শনিবার  বলেন, যেকোনো ভাবেই শিক্ষার্থীদের করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদে রাখা হবে। এজন্য যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করতে হয় তা-ও করা হবে। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ কর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এরপরও একধরনের ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যাচ্ছে। ঝুঁকি এড়াতে সাময়িকভাবে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের চিন্তাভাবনা চলছে। আগামী দু-তিনদিনের মধ্যে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

করোনার কারণে শনিবার পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গে সব স্কুল-কলেজ ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে সেখানের হোস্টেলে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের হোস্টেল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তরাখন্ডের বিভিন্ন স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। পাকিস্তানে মাত্র ২৮ জন করোনা আক্রান্ত হলেও সিন্ধু প্রদেশের স্কুলগুলো ৩০ তারিখ পর্যন্ত ছুটি বাড়িয়েছে সরকার। শ্রীলঙ্কায় প্রথম করোনা আক্রান্তের খবর পাওয়ার পরই দেশ জুড়ে ১৩ মার্চ থেকে সব স্কুল বন্ধ করে দেয় সরকার। নেপালেও স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যুক্তরাষ্ট্রে জরুরি অবস্থা জারি করায় অন্তত ১২টি অঙ্গরাজ্যের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ব্রাজিলে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে।

করোনা মোকাবিলায় পদক্ষেপ হিসেবে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইতালি, গ্রিস, পর্তুগালসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট নিকোস আনাস্তাসিয়াডিস ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

আমাদের বাণী ডট কম/ ১৫ মার্চ ২০২০/বিপি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।