কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রথম ব্যাচ থেকেই ভর্তি ফরম ও রেজিস্ট্রেশন ফরমে শিক্ষার্থীদের ধূমপান ও রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার অঙ্গীকার করতে হয়। কিন্তু ধূমপান ও ছাত্র-রাজনীতি না করার অঙ্গীকার থাকলেও বাস্তবে তা মানছে না কেউ। ধূমপান ও ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতিতে সবসময় সরব থাকে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেও বিভিন্ন সময় ছাত্রসংগঠনের শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ আছে,’আমি এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি রাজনীতি ও ধূমপান মুক্ত ক্যাম্পাস হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত পুরোপুরি মেনে চলতে সচেষ্ট থাকবো।’ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র একদম ভিন্ন। শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীসহ শিক্ষার্থীরা জড়িত রাজনীতিতে। দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব ব্যতীত হয়না নিয়োগ, মেলে না প্রশাসনিক পদবী।

অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের রয়েছে একক প্রভাব। ছাত্রলীগের ৭১ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত র্যালিতে অংশগ্রহণও করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যানারে ছাত্রলীগের পদধারী নেতাদের নামসহ অতিথি করা হয়েছে।

বর্তমানে ক্যাম্পাসের সব জায়গায় ছাত্র রাজনীতির প্রভাব বিস্তার করছে। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে চলছে আবাসিক হলগুলো। এমনকি ছাত্র সংগঠনের নিয়মিত কর্মকান্ডে না গেলে হলে সিটও মিলেনা। বর্তমানে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের ২য় কমিটি চলছে। পূর্নাঙ্গ এ কমিটির সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদ। চলমান কমিটি দেওয়া হয় ২০১৭ সালের ২৬ মে। বর্তমান কমিটির মেয়াদ দেড় বছর আগে শেষ হলেও দেওয়া হয়নি কাউন্সিল।

ছাত্রলীগের সহিংস রাজনীতি ও দলীয় গ্রুপিংয়ের কারনে ২০১৬ সালের আগস্টে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খালেদ সাইফুল্লাহ। শুধু সাইফুল্লাহ হত্যাই নয় ছাত্রলীগের নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে মারামারির ও সংঘর্ষের ঘটনা রয়েছে অসংখ্য। ২০১৫ সাল থেকে শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নিজ দলীয় নেতাকর্মীসহ প্রায় দুই শতাধিক সাধারণ শিক্ষার্থীরা মারধরের শিকার হয়েছে। এসব মারধরের বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ জানানোর পরেও বিচার করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শিক্ষক লাঞ্ছনা, সাংবাদিকদের মারধর ও লাঞ্ছনা, দলীয় নেতাকর্মীদের মারধর, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ থাকলেও বিষয়গুলো বারবারই এড়িয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদন। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ছাত্রলীগ থেকে আজীবন, সাময়িকসহ বিভিন্ন মেয়াদে বহিস্কার করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছিল নিরব। এমনকি প্রশাসনের কাছে বিচার দিলে ছাত্রলীগের সাথে বসে সেগুলো মিমাংসা করতেও বাধ্য করতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাই অনেকে মারধরের শিকার হয়েও মুখ খুলতে পারতো না। শুধু তাই নয় বিচারের আশ্বাস দিয়ে ডেকে এনে আবারও মারধর করার অভিযোগ রয়েছে শাখা ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে। ক্যাম্পাসে শাখা ছাত্রদলের কমিটি থাকলেও তাদের নেই কোন কার্যক্রম। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসের দিকে তাদের অবস্থান করার চেষ্টা করলেও ছাত্রলীগের কারণে তা ব্যর্থ হয়। এমনকি বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা মারধরের শিকার হয়ে ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়েছে তাদের। ছাত্র রাজনীতির সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের মধ্যেও রয়েছে রাজনীতি। ফুল দেওয়াকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের দুই গ্রুপে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা বললে তারা জানান, ‘রাজনীতি ও ধূমপান মুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে আমরা ভর্তি হই। কিন্তু ভর্তির পরে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও তা ভঙ্গ করতে দেখি। আবাসিক হলগুলোতে যেখানে থাকবে পড়াশুনা করার একটি পরিবেশ সেখানে রাজনীতি না করার ফলে হল ছাড়তে হয়।’

ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ধূমপান না করার অঙ্গীকার করলেও বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক, কর্মকর্তা, শিক্ষার্থীরা ধূমপান করছে। শুধু ধূমপানই নয় ক্যাম্পাসের ভেতরে ও আবাসিক হলগুলোতে বসে মাদকের আসর। এমনকি বহিরাগতদের নিয়েও ছাত্র হলগুলোতে মাদক সেবন করা হয় বলে জানান আবাসিক হলগুলো বেশ কয়েকজন আবাসিক শিক্ষার্থী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাঁচজন শিক্ষার্থী বলেন,‘যে ক্যাম্পাসে ধূমপান ও রাজনীতি মুক্ত থাকার অঙ্গীকার করা হয় সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই যদি প্রকাশ্যে ধূমপান করেন তবে সেখানে শিক্ষার্থীরা আর কি শিখবে। শিক্ষার্থীরা শুধু ধূমপানই নয় আবাসিক হলগুলোতে দলীয় ছত্র-ছায়ায় বসে মাদকের আসর।’

ক্যাম্পাসে রাজনীতির প্রভাব নিয়ে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সাথে। তারা জানান, ‘বাংলাদেশের কোনো জায়গাই রাজনীতি মুক্ত নয়। এবিশ্ববিদ্যালয় তার বাহিরে নয়। তারপরেও এখানে শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি যে প্রকট আকার ধারণ করেছে সেটা ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরুপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, প্রভোস্টবৃন্দও যেখানে ছাত্রলীগ নেতাদের কথার বাহিরে যেতে পারে না সেখানে সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী তো কিছুই না।’ উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী বলেন,‘যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের আধিপত্যই ক্যাম্পাসে দেখা যায়। এটা একটা রীতি হয়ে গেছে। যদি ছাত্রনেতারা একসাথে ২০-২৫ জন এসে কোন বিষয়ে চাপ দেয় সেখানে আমারও কিছু করার থাকে না। বিষয়গুলো নিয়ে আমরা শিক্ষক, ছাত্রনেতা এবং শিক্ষার্থীদের সাথে বসে একটা সমাধানে আসবো।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।