‘মাত্র ১৬০ টাকা। অনেকের কাছে সামান্য অর্থ হতে পারে, যা জোগাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারি নাই। অর্থের অভাবে অনেকদিন না খেয়ে থেকেছি। এরপরও জীবন সংগ্রামের কাছে হার মানি নাই। অক্লান্ত পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাস আজকে আমাকে এখানে এনেছে। আজ আমি দেশের সেরা একজন শিল্পপতি।’

বলছিলেন, বিশিষ্ট সমাজসেবক, শিল্পপতি আবদুল কাদির মোল্লা। মঙ্গলবার ঢাকা কলেজ আয়োজিত ‘আপন আলোয়’ নামে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে নিজের জীবনের কথাগুলো এভাবে তুলে ধরেন তিনি।

আবদুল কাদির মোল্লা বলেন, ‘আপনাদের কাছে মনে হতে পারে ১৬০ টাকার জন্য আমি পরীক্ষা দিতে পারি নাই! আসলে এটাই বাস্তব। এটাই সত্য। এটাও আমাকে আঘাত করতে পারে নাই। শরীরের জোর ছিল, বয়স ছিল, কাজ করার মানসিকতা ছিল, কাজ করেছি, তাই আজ এই জায়গায় আসতে পেরেছি। তার চেয়ে কঠিন বিষয় যেটি আমার জীবনে, তা হলো- আমি সর্বহারা মানুষ।’

‘সর্বহারা বলছি এ কারণে যে- আমার বাবা, মা, ভাই, বোন কেউ নেই। না খেতে পারা, না পাওয়া, চিকিৎসার অভাবে একের পর এক আপনজনের বিদায় হয়েছে আমার চোখের সামনে। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় প্রথমে বাবা মারা যান। তারপর মা, ছোট বোন, ছোট দুই ভাই মারা গেলো। শুধু আমিই বেঁচে ছিলাম। আজ আমার ভাই, বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই। কিন্তু যারা আমার আপনজন তারা না খেতে পেরে অভাবের তাড়নায় চিকিৎসার অভাবে কষ্ট পেয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। তাদের বিষয়গুলো আমাকে অনেক বেশি কষ্ট দেয়। আজও আমাকে কাঁদায়।’

তিনি বলেন, ‘আমার খুব গর্ব হয় যে, আমার বাবা একজন দিনমজুর ছিলেন। আমার চোখের সামনে অন্যের জমিতে কাজ করতেন, মক্তবে পড়াতেন, সেই জায়গা থেকে ৬ মাস পরপর কিছু ধান, চাল আদায় করে আমাদের সংসার চলত।’

‘আমি শিক্ষকদের খুব সম্মান করি। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় কিডনি রোগে যখন বাবা মারা গেলেন তখন মা অন্যের বাসায় ঝিয়ের কাজ করেন। আমার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেলো। তখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। সেদিন আব্দুর রহমান স্যার (আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক) যার কাছে আমি আজীবন ঋণী। তিনি আমাকে লেখাপড়া বন্ধ করতে দেননি। স্যার আমাকে টিউশন ফি, ভর্তির ফি মওকুফ করে দিয়েছিলেন। স্যার তখন গ্রামে আমাকে লজিং বাড়িতে থেকে পড়ালেখার ব্যবস্থা করে দিলেন। এরপর চার-পাঁচটা প্রাইমারি স্কুলের ছেলে-মেয়েকে পড়িয়ে যা দুই-চার টাকা পেতাম তা দিয়েই বই আর খাতা কেনার খরচ চালাতাম।’

‘একসময় এলাকার লোকদের অত্যাচারে মা আমার দুই ভাই ও বোনকে নিয়ে মামা বাড়িতে চলে যান। পরে অন্য জায়গায় মায়ের বিয়ে হলে মামীদের অত্যাচারে দুই ভাই বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেও ছোট বোনটি পালাতে পারেনি। অনেকদিন পর আমি যখন মামাবাড়িতে গেলাম তখন জানতে পারলাম, তাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ছোট বোনটি রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এভাবেই আমার জীবনে একের পর এক ঝড় আসতে থাকে’,- এ কথা বলে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন তিনি।

‘মেট্রিক (এসএসসি) পাস করার পর কলেজে ভর্তি হই। তখন অন্যের বাসায় থেকে পড়ালেখা করি। সপ্তাহে দুইদিন ওই বাড়ির গৃহকর্তাকে সহযোগিতা করার জন্য দূরের হাটে লুঙ্গির বস্তা মাথায় নিয়ে যেতাম। এভাবে চলে কলেজ জীবনের পড়ালেখা। পরীক্ষার আগে ফরম পূরণে ৩৬০ টাকার জন্য ২০০ টাকা জোগাড় করতে পারলেও ১৬০ টাকার অভাবে পরীক্ষা দিতে পারিনি। কলেজের অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে পরিচালনা পরিষদের সভাপতির বাড়ি অনেকবার যেয়েও আমার ফরম পূরণ করতে পারিনি। পরীক্ষাও দেয়া হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘দিনমজুর খেটে উপার্জনের টাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জে যাই। যেয়ে দেখতে পেলাম মেরিন টেকনোলজিতে এসএসসি পাসে ভর্তি চলছে। দরখাস্ত করে ভর্তির সুযোগ পেলাম।’

এরপর কোর্স শেষ করে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান তিনি। দীর্ঘ পাঁচ বছর প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে প্রথমে একটা চাকরিতে যোগদান করেন। কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে গড়ে তোলেন ছোট আকারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সেখান থেকেই শুরু। নিজ পরিশ্রম আর একাগ্রতা দিয়ে গড়ে তুলেছেন দেশের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান থার্মেক্স গ্রুপ। বর্তমানে তিনি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

উপস্থিত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আবদুল কাদির মোল্লা বলেন, ‘জীবনে চলার পথে বাধা-বিপত্তি আসবে। হতাশ হলে চলবে না। সেগুলোকে পরীক্ষা মনে করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। তাহলেই সাফল্যের শীর্ষে নিজেকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।’

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর নেহাল আহমেদ। সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আজ এমন একজন মানুষকে আমরা পেয়েছি, যিনি শূন্য থেকে শিখরে গেছেন। এই মহান ব্যক্তির জীবন থেকে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। আমাদের অনেক ছাত্র আছে, যাদের জীবনে দুঃখ, কষ্ট, হতাশা আছে। আশা করি, আজ আবদুল কাদির মোল্লার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা জীবনের হতাশা কাটিয়ে আলোর দিশা পাবে।’

ঢাকা কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর এ টি এম মঈনুল হোসেন, অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর এ কে এম সালাউদ্দিন, বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যানগন, শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ শিক্ষার্থীরাও উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে আবদুল কাদির মোল্লা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের কষ্ট লাঘবের জন্য চারটি বাস ও শিক্ষকদের জন্য একটি মাইক্রোবাস দেয়ার ঘোষণা দেন। এছাড়া আগামীতে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।

আলোচনা শেষে মনোজ্ঞ এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

প্রসঙ্গত, আবদুল কাদির মোল্লা ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট নরসিংদী জেলার মনোহরদী থানার পাঁচকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমান দেশের অন্যতম শিল্পপতি এই ব্যক্তিত্ব ‘মানুষ মানুষের জন্য, সেবা আমাদের অঙ্গীকার’ এই মিশন নিয়ে তার বাবার নামে গড়ে তুলেছেন মজিদ মোল্লা ফাউন্ডেশন। যেখান থেকে অনেক সামাজিক কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। ২০১৮ সালে মাদার তেরেসা অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত এই ব্যক্তি সংসার জীবনে তিন কন্যা সন্তানের জনক।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।