মাদারীপুরে পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগে প্রায় কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে জেলা পুলিশের একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে প্রতারণার অভিযোগে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদারের দেহরক্ষীসহ ২ কনস্টেবলকে আটকের পর নেয়া হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। এছাড়া একই অভিযোগে আরো দুই কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক জেলা থেকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে পুলিশ সুপার তার নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছেন।

স্থানীয় ও সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, মাদারীপুরে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে ঘুষ গ্রহণ ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় ২৪ জুন পুলিশ সদর দপ্তর থেকে অপরাধীদের ধরার জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। এই অভিযানে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদারের দেহরক্ষী পুলিশ সদস্য নুরুজ্জামান সুমনকে ঘুষের টাকাসহ আটক করে। এছাড়াও পুলিশ সদস্য ও পুলিশ লাইন্সের ম্যাস ম্যানেজার জাহিদ হোসেন, টিএসআই গোলাম রহমান এবং পুলিশ হাসপাতালের স্বাস্থ্য সহকারী পিয়াস বালার কাছ থেকেও ঘুষের টাকা উদ্ধার করা হয়। পরে নুরুজ্জামান সুমন ও জাহিদ হোসেনকে পুলিশ সদর দপ্তরে নজরদারীতে রাখা হয়। টিএসআই গোলাম রহমান এবং পুলিশ হাসপাতালের স্বাস্থ্য সহকারী পিয়াস বালাকে মাদারীপুর জেলা থেকে অন্যত্র শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে। ঘটনাটি গত সোমবার রাতে হলেও বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। কয়েক দফায় মাদারীপুর জেলা পুলিশের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে এ বিষয় কথা বলতে রাজি হয়নি তারা। পরে বিষয়টি জানতে বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া এন্ড পিআর) সোহেল রানাকে অবগত করলে তিনি আটকের বিষয়টি স্বীকার করেন। এ অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে তড়িঘড়ি করে মাদারীপুর পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদার জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিষয়টি অবগত করেন।

সূত্র জানিয়েছে, ‘গত ২২ জুন মাদারীপুর জেলা থেকে ৫৪ জন পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের জন্যে শারিরীক পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেখান থেকে উত্তীর্ণদের ২৩ জুন সরকারী নাজিমউদ্দিন কলেজে একটি কক্ষে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরদিন বিকেল ৫টার মধ্যে ফলাফল দেওয়ার কথা থাকলেও রাত ১০টার দিকে ফলাফল জানানো হয়। এতে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে নানা গুঞ্জন তৈরি হয়।’

অভিযোগ উঠে, এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন মহল মোটা অঙ্কের উৎচোকের বিনিময় অনেক প্রার্থীকে চাকুরি দিয়েছে।

এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সোহেল রানা জানান, ‘এবার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে একাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশ হিসেবে কাউকে ছাড় দেয়া হয়নি। মাদারীপুরেও যেসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তাদের বিরুদ্ধেও আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। নির্ভেজাল নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য যা করা দরকার পুলিশ সদর দপ্তর তা করেছে। যে সকল জেলা থেকেই আমরা খবর পেয়েছি সেখানেই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।’

এদিকে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার সুব্রত কুমার হালদার সংবাদ সম্মেলনে জানান, দুর্নীতি বন্ধের ব্যাপারে মাদারীপুর পুলিশের ডিবি-ডিএসবিসহ পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা ছাড়াও পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে আইজিপি মহোদয়ের একটি বিশেষ টিম এসেছিল যাদের মধ্যে এসপি র‌্যাঙ্কের একজন, অতিরিক্ত এসপি র‌্যাঙ্কের একজন ছিলেন। এছাড়াও গোয়েন্দা টিমের একজন অতিরিক্ত এসপি ও একজন ইন্সপেক্টর এসেছিল। ডিআইজি ঢাকা রেঞ্জের ৭-৮ জনের একটি টিম এখানে গোয়েন্দা নজরদারি করেছে। ১৭ জুন থেকেই সবাই মাদারীপুরে কাজ করেছেন।

তিনি বলেন, ২২ জুন শারীরিক বাছাই পরীক্ষা ও ২৩ জুন লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু আগের দিন ২১ জুন পুলিশ হাসপাতালের মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পিয়াস বালার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় ডিআইজি মহোদয় তাকে কিশোরগঞ্জে বদলি করে দেন। তখন সে টাকা গ্রহণের অপতৎপরতার কথা অস্বীকার করে।

পুলিশ সুপার জানান, অবশ্য পরে জিজ্ঞাসাবাদে পিয়াস ঘুষ গ্রহণের কথা স্বীকার করে এবং এই টাকা সে তার স্ত্রীর কাছে রেখেছিল বলে জানায়। তার কাছ থেকেও কিছু টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।

এরই মধ্যে ২৪ তারিখে তারিখে পুলিশের কাছে তথ্য আসে পুলিশ লাইনের মেস ম্যানেজার জাহিদ হাসান কোনো এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে চাকরি দেওয়ার নাম করে ৩ লাখ টাকা গ্রহণ করে। ওই চাকরি প্রার্থী শারীরিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ে। এরপর তাকে আটক করে ঢাকায় রেঞ্জ অফিসে ডিআইজি স্যারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

সুব্রত কুমার আরো জানান, এরপর ২৫ জুন বিকেলে অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ সদস্য নূরুজ্জামান সুমনকে আটক করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকায় গিয়ে সে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা দালালদের মতো কাজ করেছে, তারা চাকরি দেওয়ার নামে টাকা গ্রহণ করে তাদের কাছে গচ্ছিত রাখে।

তিনি বলেন, প্রথম নিয়োগ তাই এ ব্যাপারে কঠোর তদারকি করতে হবে। এজন্য প্রাথমিকভাবে যারা অপতৎপরতায় লিপ্ত ছিল তাদের আটক করায় দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে।

এই পুলিশ সুপারের দাবি, আইজিপি মহোদয়ের সদিচ্ছায় এবার মাদারীপুরে যে ৫৪ জনের চাকরি হয়েছে, তা ঘুষ মুক্তভাবে করা সম্ভব হয়েছে।

এদিকে তার দেহরক্ষীকে টাকাসহ আটকের বিষয় তিনি বলেন, ‘যার যার অপরাধের দায়ভার তারই।’

পুলিশ আটকের বিষষয়ে মাদারীপুর সদর থানার ওসি সওগাতুল আলম জানান, ‘পুলিশ নিয়োগের ব্যাপারে কাউকে আটক, গ্রেপ্তার বা অন্য কোন বিষয়ে আমি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কিছু বলতে পারবো না।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।