সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন বর্ষপুঞ্জি প্রকাশের পর তার আলোচনা সমালোচনা চলছে সর্বত্রই। শিক্ষকরা দাবি করছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রকাশিত নতুন ছুটির তালিকায় বৈষম্য করা হয়েছে। অন্যদিকে এই বর্ষপুঞ্জি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন খোদ প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও। তাদের দাবি কোমলমতি শিশুদের নতুন এই শিক্ষাপঞ্জিতে মানসিক বিকাশের অন্তরায় কারণ হিসেবে তারা বলেছে এই বয়সী শিশুদের বই স্কুলের মধ্যে আবদ্ধ করে না রেখে খেলাধুলা ও বিনোদনে বেশি সময় দেওয়া প্রয়োজন তাহলেই তাদের মানসিক বিকাশ ঘটবে। শিক্ষকদের দাবি প্রাথমিকের সময়সূচী করা হোক সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত। অভিভাবকরাও এই দাবির প্রতি সম্মতি জানিয়েছেন। এদিকে সরকারি প্রাথমিক প্রধান শিক্ষক সমিতিও একই দাবিতে আল্টিমেটাম দিয়ে রেখেছে। এই আলোচনা সমালোচনার মধ্যে শিক্ষকদের দাবি ও অধিদপ্তরের দেওয়া সময়সূচীর সামঞ্জ্যসতা করে বিদ্যালয়ের সময়সূচী সকাল দশটা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত করার জন্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি পাঠিয়েছেন এক প্রাথমিক শিক্ষক। সেই সাথে ক্লাস রুটিনের একটি ডেমোও সংযুক্ত করে দিয়েছেন তিনি।

মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার চরযোগেন্দ্র আমতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান এর পাঠানো চিঠি ও সম্ভাব্য ক্লাস রুটিন আমাদের বাণী ডট কম এর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল;

বরাবর,

মহাপরিচালক (অতিরিক্ত)

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, ঢাকা।

বিষয়: দুই শিফট বিশিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণি রুটিন সকাল ১০:০০ হতে বিকাল ৪:০০ টা পর্যন্ত পুনর্নির্ধারণ প্রসঙ্গে।

জনাব, সবিনয় নিবেদন এই যে,আমরা আপনার অধীনস্থ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে কর্মরত শিক্ষকবৃন্দ। আপনি আমাদের একজন মহানুভব অভিভাবক। আপনার বরাবর একটি বিনীত প্রস্তাব উপস্থাপন করছি। গত কয়েকদিন হলো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর দৈনিক ক্লাস রুটিন আপনি অনুমোদন করেছেন। আপনার অনুমোদিত ক্লাস রুটিনে দেখা যাচ্ছে যে,এক শিফট ও দুই শিফট বিশিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ক্লাস রুটিনে দুই শিফটের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের প্রতি কিছুটা বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এক শিফটের বিদ্যালয়গুলোর শ্রেণি কার্যক্রম সকাল ৯:০০ টা থেকে ৩:১৫ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হলেও, দুই শিফটের বিদ্যালয়গুলোর শ্রেণি কার্যক্রম নির্ধারণ করা হয়েছে সকাল ৯:০০ টা থেকে বিকাল ৪:০০ পর্যন্ত। যা স্পষ্টত নাগরিক বৈষম্যের শামিল। দুই শিফটের বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং শিক্ষক নেই বিধায়,এক শিফটের বিদ্যালয়গুলোর তুলনায় এমনিতেই তাদের অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়।

সে হিসেবে তারা যাতে একটু রিলাক্সে থাকতে পারেন,দুই শিফটের বিদ্যালয়গুলোর জন্য সেরকম ক্লাসরুটিনই হওয়া বাঞ্চনীয়। অথচ আপনার অনুমোদিত ক্লাসরুটিন বরং এক্ষেত্রে আরো বেশি বৈষম্যমূলক হয়ে গিয়েছে। একই যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও,শুধুমাত্র শিফট ভিন্ন হবার কারণে দুই শিফটের শিক্ষকগণ এক শিফটের শিক্ষকগণের তুলনায় অতিরিক্ত পরিশ্রম করবেন সেটা মোটেও কাম্য হতে পারে না। আমরা দুই শিফটে পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকগণ এরকম বৈষম্যের তীব্র বিরোধীতা করছি। আমরা আশা রাখতে চাই যে,আপনি আপনার সহানুভূতিশীল হৃদয় দিয়ে বিবেচনাপূর্বক আমাদের প্রতি শ্রেণি রুটিন সময়ের যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে তা দূরীকরণে আপনি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২৮(৪) এ বলা হয়েছে যে,নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্র নারী ও শিশুদের জন্য তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারবে। আমরা দেখেছি যে,মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয় সকাল ১০:০০ টা থেকে। অথচ মাধ্যমিকের চেয়ে প্রাথমিক শিশুরাই বরং তুলনামূলক শিশুর আওতায় পড়ে। এখন তো আবার ৪-৫+ বয়সী শিশুরাই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হচ্ছে। এতো ছোট ছোট শিশুদের পক্ষে আসলে সকাল ৯:০০ টায় বিদ্যালয়ে হাজির হওয়াটা সম্ভবপর নয়।

বিদ্যালয় সংলগ্ন কিছু কিছু শিশু হয়তো সকাল ৯:০০ টায়ই বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু দূর দূরান্ত থেকে আগত অধিকাংশ শিশুর পক্ষেই সকাল ৯:০০ টার মধ্যে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়া সম্ভব হয় না। যে কারণে তাদের শ্রেণি পাঠগ্রহণ অনেক পিছিয়ে যায়। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে চাইলে আমাদের সর্বাগ্রে বাস্তব সমস্যাগুলো রিয়েলাইজ করতে হবে। আসল সমস্যাগুলো লুকিয়ে রেখে, সমাধানের কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ না করে যদি আমরা গতানুগতিক নিয়মে চলি তাহলে আমরা কোনোভাবেই মান সম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারবো না।

আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাও তাহলে সেই কাজীর গরুর মতোই কিতাবে আছে,গোয়ালে নেই এমন মান সম্মত বলে স্বীকৃতি পাবে। মূলত এমন মান সম্মত প্রাথমিক শিক্ষা আমাদের কোন কাজেই আসবে না। প্রাথমিকের ৬০% শিক্ষকই নারী। অতএব নারী ও শিশু উভয়ের সুবিধার কথা চিন্তা করেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস রুটিন সকাল ১০:০০ টা হতে বিকাল ৪:০০ টা পর্যন্ত পুনর্নির্ধারণ করার জন্য আপনার নিকট বিনীত প্রার্থনা জানাচ্ছি। আমাদের সংবিধান নারী ও শিশুদের জন্য যে বিশেষ বিধানের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, একজন দায়িত্বশীল অভিভাবকের দায়িত্ব তাদের সেই সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। আমরা আপনার কাছে নারী ও শিশুদের অনুকূলে প্রণীত সেরকম দায়িত্বশীল শ্রেণি রুটিন প্রত্যাশা করছি।

দুই শিফট বিশিষ্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের জন্য সকাল ১০:০০ টা হতে বিকাল ৪:০০ টা পর্যন্ত প্রত্যাশিত শ্রেণি রুটিনের একটি নমুনা আপনার সদয় বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হলো।

শিক্ষকের দেওয়া দুই শিফট বিষিষ্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রত্যাশি সময়সূচী 

প্রাথমিকের নতুন রুটিন

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান নামের ঐ প্রাথমিক শিক্ষকদের অধিদপ্তর বরাবর দেওয়া এই প্রত্যাশিত সময়সূচী শিক্ষকদের মধ্যে আলোড়ন তৈরি করেছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।