সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ব্যবসায়ী রাজন আহমেদের স্ত্রী সহকারী শিক্ষিকা গুলশানারা পারভীন পান্নাকে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করা উল্লাপাড়ার পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম মাত্র চার বছরের ব্যবধানে তিন বিঘা জমিসহ ৫ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন।

পৌর এলাকায় নানা প্রকল্প, ২০১৫-১৬ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এডিপি থেকে মসজিদ-মাদরাসা, কবরস্থান, মন্দির ও শশ্মানের নামে বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাৎ করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি।

গত রোববার (১০ নভেম্বর) দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজপোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কম’এ ‘স্ত্রীকে ভাগিয়ে নিয়ে গেলেন মেয়র, ভয়ে চুপ স্বামী’ সংবাদ প্রকাশ হলে সিরাজগঞ্জসহ দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এরপর থেকেই বেরিয়ে আসছে মেয়র নজরুল ইসলামের নানা অজানা কাহিনি।

গত অক্টোবরে মেয়র নজরুল ইসলামের দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়টি দুদকের নজরে এলে তদন্তের স্বার্থে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত পাবনা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আতিকুর রহমান স্বাক্ষরিত পত্রে মেয়রের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির রেকর্ড পাঠাতে উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। ঘটনাটি উল্লাপাড়া উপজেলাজুড়ে টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়।

জানা গেছে, ২০০৪ সালে উল্লাপাড়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নজরুল ইসলাম। ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ থেকে সমর্থন নিয়ে নৌকা প্রতীকে মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। দায়িত্ব নেয়ার চার বছরের মধ্যে দুর্নীতির টাকায় সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি।

উন্নয়ন খাতের অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়ে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। পৌরসভার আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে মেয়র ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। কাউন্সিলরের সঙ্গে কোনো বিষয়ে আলোচনা না করে একাই সব কাজ করেন। চার বছর আগে সাধারণ জীবনযাপন করলেও বর্তমানে বিলাসবহুল গাড়িতে চড়েন, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত জমিতে গড়ে তুলছেন নানা প্রকল্প, ঢাকায় কিনেছেন প্লট, চার বছরে নিজ পরিবারের নামে-বেনামে কিনেছেন অসংখ্য জায়গা-জমি ও ফ্ল্যাট। যুক্ত হয়েছেন পরিবহন ব্যবসায়। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নজরুল ইসলামের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়।

পৌরসভাসহ বিভিন্ন দলীয় অনুষ্ঠানে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী নিয়ে চলাচল শুরু করেন। এদের ভয়েই পৌরসভার কাউন্সিলররা মুখ খুলতে সাহস পান না। একসময় অভাব থাকলেও বর্তমানে চালচলন আচার-আচরণে রাজকীয় ভাব দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন উল্লাপাড়ার মানুষ।

স্থানীয়দের অভিযোগে জানা যায়, উল্লাপাড়া পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সব কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি করে পৌরসভাকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। এছাড়া মেয়র কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পৌরসভার কাউন্সিলরদের অন্ধকারে রেখে যাবতীয় অপকর্ম করছেন। পৌরসভার রাস্তা-ঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজ তিনি গোপনে দরপত্র করে নিজের লাইসেন্স ছোট ভাই বা অনুগত ঠিকাদারদের দিয়ে নিম্নমানের কাজ করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়েই মেয়র নজরুল ইসলাম ২০১৭ সালের ১৬ মে উল্লাপাড়া উপজেলার বাখুয়া মৌজায় আব্দুল জলিল সরকারের প্রায় ৩ কোটি টাকা মূল্যের জমি সরকারি ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার জন্য গোপন দলিলে ১ কোটি টাকায় ক্রয় দেখিয়েছেন। যার দলিল নং-২৮৭৩।

একই বছরের ১৬ মে বাখুয়া মৌজায় আল মাহমুদের কাছ থেকে অর্ধ ডিসিমেল জায়গা মেয়র নজরুল ইসলাম ৮০ হাজার টাকা মূল্যে ক্রয় করেন। যার দলিল নম্বর-২৮০৩। একই বছরের ১১ জুলাই মো. আব্দুল হান্নান সরকারের কাছ থেকে বাখুয়া মৌজায় তার প্রথম স্ত্রী জেসমিন আরার নামে ৪৩ একর জায়গা ১০ লাখ টাকা মূল্যে ক্রয় করেন। যার দলিল নম্বর-৩৪৭২। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে ২০১৯ সালের ২৫ জুন বাখুয়া মৌজা থেকে আশরাফ আলীর কাছ থেকে ৫ শতক জায়গা মেয়র নজরুল ইসলাম তার বাবা চাঁদ আলীর নামে ২০ লাখ টাকা মূল্যে ক্রয় করেন। যার দলিল নং-৩১৯৯। প্রমাণসহ এমন অসংখ্য দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে মেয়র নজরুলের বিরুদ্ধে।

অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে ভুক্তভোগী উল্লাপাড়া পৌর এলাকার চর ঘাটিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মসজিদের মাটি ভরাটের জন্য ১৬-১৭ অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ দুই বছরেও বরাদ্দকৃত অর্থ পাইনি।

উল্লাপাড়া পৌর এলাকার ঘাটিনা পশ্চিমপাড়া আজাদ মসজিদের সভাপতি আব্দুল মান্নান, ঘোষগাতি মৃধাবাড়ী জামে মসজিদের সভাপতি ফজলুল হক মৃধা, চর ঘাটিনা দক্ষিণপাড়া মসজিদের সভাপতি মঈনুল হক ও চর ত্রিফলগাঁতি পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদের সভাপতি মিজানুর রহমান জানান, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মসজিদ উন্নয়নের জন্য এডিপি থেকে ৫০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়। দীর্ঘ দুই বছর একাধিকবার পৌর মেয়রের কাছে ঘুরে বরাদ্দকৃত টাকা উত্তোলন করতে পারিনি। পরে শুনেছি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

দুদকের তথ্য চাওয়ার বিষয়ে উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আরিফুজ্জামান জানান, আওয়ামী লীগ সমর্থিত পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাতের যে রেকর্ডপত্রসহ নির্বাচনী হলফনামা চাওয়া হয়েছিল তা ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। তারা তদন্তপূর্বক যা করণীয় তা করবে।

এ বিষয়ে উল্লাপাড়া পৌরসভার মেয়র এস এম নজরুল ইসলাম বলেন, এডিপির বরাদ্দে কিছু সমস্যা হয়। তবে বরাদ্দকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুদানের অর্থ দেয়া হয়েছে। মসজিদ, মন্দিরের নামে বরাদ্দকৃত টাকা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও পায়নি এমন প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আমি কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত নই। চার বছরের ব্যবধানে আটটি জায়গা ক্রয় করেছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার নামে কোনো জায়গা-জমি নেই। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার। তবে দ্বিতীয় বিয়ে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হলেও তিনি বলেন, গুলশানারা পারভীন পান্না আমার স্ত্রী। তাকেই নিয়ে আমি ঘর সংসার করছি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।