দেশের বন্যা পরিস্থিতি আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে ২৮ জেলা কমবেশি বন্যাকবলিত। এর মধ্যে কয়েকটি জেলা গত ২-৩ দিনে আক্রান্ত হয়েছে। অন্তত ২৫ জেলার মানুষ সর্বনিন্ম এক সপ্তাহ থেকে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ ধরে বন্যার সঙ্গে লড়ছেন।

লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষের মাঝে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। অনেকের ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। সহায়-সম্বল নিয়ে অনেকে আশ্রয় কেন্দ্র, বাঁধ বা উঁচু স্থানে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন। কেউ বা নৌকায় আশ্রয় নিয়ে দিনের পর দিন পানিতে ভাসছেন। বন্যার্ত মানুষের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সরকারিভাবে বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা অপ্রতুল বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা। বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে চার জেলায় আরও ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ উত্তর-মধ্যাঞ্চলের আরও ২-৩টি জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। বন্যার কারণে কারিগরি বোর্ডের অধীন ডিপ্লোমা-ইন-ফিশারিজ ও ডিপ্লোমা-ইন-লাইভস্টক প্রোগ্রামের আগামী ২১ থেকে ২৫ জুলাইয়ের সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বানের পানি এবং দেশের ভেতরের বৃষ্টির কারণে সৃষ্টি হয়েছে এই বন্যা। তবে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে বৃষ্টি কমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পানি নামছে। কিন্তু আগামী এক সপ্তাহেও বন্যা পরিস্থিতি থেকে পুরোপুরি মুক্তির কোনো আশা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। বরং বাংলাদেশ-ভারতের আবহাওয়া সংস্থাগুলো ২১ জুলাই থেকে ফের ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে বন্যা পরিস্থিতি উত্তরণে ধীরগতির আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।

এবারের বন্যার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হল নদ-নদীতে রেকর্ড পরিমাণ পানির প্রবাহ। যমুনা নদী জামালপুরের বাহাদুরাবাদে ইতিহাসের সর্বাধিক পানি বহন করে। একই অবস্থা ছিল নীলফামারীতে তিস্তা এবং বান্দরবানে সাঙ্গু নদীতে। অতীতে কখনই এই তিন নদীর পানি এত ওপরে ওঠেনি।

শুক্রবার পর্যন্ত বন্যায় আক্রান্ত জেলাগুলোর মধ্যে আছে- কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার। এছাড়া চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার, জেলায় বন্যায় আক্রান্ত। ঢাকার ডেমরা, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর পানি বিপদসীমার কাছে অবস্থান করছে। এছাড়া শেরপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও শরীয়তপুরে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বন্যার পানি পৌঁছে যাবে।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, বাহাদুরাবাদ পয়েন্টের পর যমুনার পানি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হতো। কিন্তু পলি পড়ে প্রধান চ্যানেল ধীরে ধীরে বামদিকে সরে গেছে। একটি চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে প্রত্যাশিত মাত্রায় পানি নামতে পারেনি। তিনি বলেন, উজান থেকে যে বৃষ্টির পানি বেশি এসেছে তা নয়। ১৯৮৮ সালে এই পয়েন্ট দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ২ হাজার কিউসেক পানি নামত, সেখানে এবার নেমেছে মাত্রা ৬৫ হাজার কিউসেক। ফলে বাকি পানি নামতে না পেরে জমা হয়েছে। এতে একদিকে অল্প পানি এলেও তা রেকর্ড ভেঙেছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান শুক্রবার বলেন, ভারতের পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টির প্রবণতা কমে এসেছে। এ কারণে পানি না বেড়ে কমার প্রবণতা শুরু হবে। বগুড়া, কুড়িগাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের কারণে জামালপুরের একটি অংশ, পদ্মার কারণে শরীয়তপুরের মানুষও বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে আগামী ২৪ ঘণ্টায়। চাঁদপুর, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় বন্যার পানির চাপ বাড়বে।

শুক্রবার এফএফডব্লিউসি’র দেয়া বুলেটিনে বলা হয়, ১৪ নদ-নদীর পানি ২২ স্টেশনে বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হয়েছে। তবে বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত নদী ও স্টেশনের সংখ্যা আরও বেশি বলে যুগান্তর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন। এফএফডব্লিউসি বলছে, সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন সুরমা, সোমেশ্বরী, তিতাস, মেঘনা, ধরলা, ঘাগট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, আত্রাই, ধলেশ্বরী ও পদ্মা বিপদসীমার ওপরে আছে। কংস, গুর, বাঙালি, ছোট যমুনা পুরাতন ব্রহ্মপুত্রও বিপদসীমার ওপরে আছে বলে জানা গেছে।

প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

টাঙ্গাইল : পানির তীব্র স্রোতে ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত নলীন-পিংনা-যোকারচর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বৃহস্পতিবার রাতে ভেঙে গেছে। বাঁধ মেরামতের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, বাঁধ ভেঙে ভূঞাপুর পৌরসভা ও ফলদা ইউনিয়নের ৭/৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভূঞাপুরের সঙ্গে তারাকান্দির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।

গাইবান্ধা : ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি কমতে শুরু করলেও নতুন করে কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সাদুল্যাপুর, পলাশবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় এখন গাইবান্ধার সাত উপজেলাই বন্যাকবলিত। শুক্রবার বন্যার পানিতে ডুবে গোবিন্দগঞ্জের মহিমাগঞ্জ সুগার মিল এলাকায় মনু মিয়ার মেয়ে মুন্নি (৭) ও বৃহস্পতিবার বিকালে সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউনিয়নের জাহেদুল ইসলামের মেয়ে জান্নাতী খাতুন (১০) মারা গেছে। ৩৬৩টি গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে প্রায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নতুন করে ১৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, উঁচু সড়ক ও আশ্রয় কেন্দ্রে বানভাসি মানুষ প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী না পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন।

কুড়িগ্রাম ও উলিপুর : জেলায় বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে দুর্ভোগ। এখনও ঘরে ফিরতে পরছেন না দুর্গতরা। এছাড়া অপ্রতুল ত্রাণের কারণে বিভিন্ন স্থানে হাহাকার দেখা দিয়েছে। শুক্রবার সকালে পানিতে পড়ে সীমা খাতুন নামে দেড় বছরের একটি শিশু মারা গেছে। সে উলিপুর পৌরসভার খাওনারদরগা গ্রামের ভাটিয়াপাড়ার সাদেক মিয়ার মেয়ে।

লালমনিরহাট : বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছে জেলা পুলিশ। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাত অবধি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রত্যেককে ৫ কেজি চাল, ২ লিটার বিশুদ্ধ পানি, আধা কেজি মুড়ি ও ৫ প্যাকেট করে বিস্কুট দেয়া হয়।

শেরপুর ও শ্রীবরদী : শেরপুর-জামালপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের পোড়ার দোকান কজওয়ের (ডাইভারশন) ওপর দিয়ে প্রবলবেগে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ায় শেরপুর থেকে জামালপুর হয়ে রাজধানী ঢাকা ও উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ শুক্রবার সকাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শেরপুর সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কাঁচা ঘর-বাড়ি, গ্রামীণ রাস্তাঘাট, রোপা আমন ধানের বীজতলা ও সবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে।

সিরাজগঞ্জ : জেলার ৫টি উপজেলার ৩৬টি ইউনিয়নের ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। যমুনাসহ অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

বগুড়া : সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীতে পানি কমতে শুরু করলেও বাঙালিতে বাড়ছে। শুক্রবার বিকাল ৬টায় যমুনার পানি ৫ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ১২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বাঙালি নদীতে পানি ১২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমা স্পর্শ করেছে। সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় প্রায় ৮২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে।

মানিকগঞ্জ : দৌলতপুর উপজেলার বাচামারা ইউনিয়নের প্রায় দু’শ বসতববাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিস্তীর্ণ ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ ও মাদারগঞ্জ (জামালপুর) : পানি বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে ভাঙন। ১ সপ্তাহে চিকাজানীর খোলাবাড়ীর চর উচ্চ বিদ্যালয়, খোলাবাড়ী গুচ্ছগ্রামের ১৫০টি পরিবারের বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

জুড়ী (মৌলভীবাজার) : শুক্রবার বিকাল ৫টায় জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন।

চরভদ্রাসন (ফরিদপুর) : চরভদ্রাসন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। উপজেলার চর ঝাউকান্দা ইউনিয়ন, চরহরিরামপুর ইউনিয়ন ও গাজীরটেক ইউনিয়নসহ সদর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের শত শত পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

জগন্নাথপুর : শুক্রবার বন্যার পানি কিছুটা কমলেও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শওকত ওসমান মজুমদার বলেন, বন্যায় এ পর্যন্ত ১১০০ হেক্টর আমন ধানের বীজতলা তলিয়ে গেছে। এছাড়া ৮০০ হেক্টর আউশ ধানের ক্ষতি হয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।