আমাদের বাণী ডেস্ক, ঢাকা; প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি ছাড়াও আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির শরীর থেকেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। তাই এই রোগে মৃতদের সৎকারে কঠোর সাবধানতা মানা হচ্ছে। তিন বছর আগে ইবোলা ভাইরাসে মৃতদের সৎকারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যে প্রটোকল নির্ধারণ করেছিল সেটাকেই সামনে রেখে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর কভিড-১৯ এ মৃতদের সৎকারের প্রক্রিয়া ঠিক করেছে, যেখানে সব ধর্মেরই বিধান মানা হবে।

দেশে গতকাল শনিবার (২১ মার্চ ২০২০) পর্যন্ত ২৪ জনের কভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের খবর দিয়েছে আইইডিসিআর। এর মধ্যে গত বুধবার একজন এবং শনিবার দ্বিতীয়জনের মৃত্যু হয়েছে।

রাজধানীতে এই ভাইরাসে মৃতদের খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থানে সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে দাফনের সিদ্ধান্ত হলেও তার আগেই প্রথম মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা হয় আজিমপুর কবরস্থানে আইইডিসিআরের তত্ত্বাবধানে। আইইডিসিআর থেকে জানা গেছে, মৃত ওই ব্যক্তির গোসল থেকে শুরু করে কবরস্থানে নিয়ে দাফন-পুরোটাই হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে। দাফনের সময় তার পরিবারেরও লোকজনও কবরস্থানে ছিলেন না বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের একজন কর্মকর্তা।

শনিবার করোনা আক্রান্তে ১ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক আহমেদ বলেন, টোলারবাগের ওই বাসার এক সদস্যের মৃত্যু হলে তারা আইইডিসিআরের নির্দেশে বাসাটিকে কোয়ারান্টিন করেন। বাসাটি যে ভবনে সেটির বাসিন্দারাও সতর্কতার অংশ হিসেবে বের হচ্ছেন না। আইইডিসিআরের নির্দেশনা মেনে মৃত ব্যক্তিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

মৃত ব্যক্তি নিজে বা তার পরিবারের কেউ বিদেশ থেকে এসেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন কোনো খবর তাদের জানা নেই। মৃতব্যক্তি অবসরপ্রাপ্ত ছিলেন, তার বয়স ৭৩। এদিকে মৃতদেহ থেকে অতিরিক্ত ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধে নির্দেশনা তৈরি করে এতে হাসপাতাল বা বাড়ি থেকে মৃতদেহ সংগ্রহ, পরিবহন, দাফনসহ প্রতিটি পর্যায়ের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

নির্দেশনা অনুযায়ী, করোনায় আক্রান্ত হয়ে বা সন্দেহভাজন কেউ মারা গেলে মৃতদেহ সরানো, সৎকার বা দাফন শুরুর আগে অবশ্যই সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) জানাতে হবে।

প্রতিষ্ঠানটির নির্দেশনা অনুযায়ী, চার সদস্যের একটি দল সম্পূর্ণ সুরক্ষা পোশাক পরে মৃতদেহ সৎকার বা দাফনের জন্য প্রস্তুত করবে। মৃত্যুর স্থানেই মৃতদেহ প্লাস্টিকের কাভার দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে হবে। দলের নেতা মৃত ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের নির্দিষ্ট কোনো অনুরোধ থাকলে তা জেনে নেবেন। কোথায় কবর দেওয়া হবে, সেটিও ঠিক করে রাখতে হবে।

নির্দেশনায় বলা হয়েছে, পরিবারের অনুরোধ থাকলে মরদেহ গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম বা পানি ছাড়া অজু করানো যাবে। আর পরিবারের পক্ষ থেকে কাফনের কাপড়ের জন্য অনুরোধ থাকলে সেলাইবিহীন সাদা সুতির কাপড় কাফনের কাপড় হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কাফনের কাপড় প্লাস্টিকের ব্যাগে রেখে তার ওপর মরদেহ রাখতে হবে এবং দ্রুত ব্যাগের জিপার বন্ধ করতে হবে। ব্যাগে কাফনের কাপড় দেওয়ার সময় যারা মরদেহ উঁচু করে ধরবেন তাদের অবশ্যই সুরক্ষা পোশাক পরে থাকতে হবে। মৃতদেহ সৎকারের জন্য মৃতদেহের সব ছিদ্রপথ (নাক, কান, পায়ুপথ ইত্যাদি) তুলা দিয়ে ভালো করে বন্ধ করে দিতে হবে, যাতে কোনো তরল গড়িয়ে না পড়ে। এরপর সংক্ষিপ্ত রুটে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মৃতদেহ সমাধিস্থলে নিয়ে যেতে হবে।

পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়ি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যাত্রাকালীন সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মৃতদেহটি দাফন পরিচালনাকারী দলের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়িতে দুটি অংশ থাকতে হবে, যাতে চালক ও পরিবহন কামরার মধ্যে প্রতিরক্ষামূলক কাচ বা প্লাস্টিকের আবরণ থাকে। পরিবহনের পর ব্যবহৃত বাহনটি জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। এ সময় জীবাণুমুক্ত করার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে অবশ্যই প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরতে হবে। দাফনের সময় মৃতদেহ বহনকারী ব্যাগটি কখনোই খোলা যাবে না।

দাফনের পর কবর বা সমাধিস্থানটি ১০-১৫ সেন্টিমিটার গভীর মাটির স্তর দিয়ে ঢাকার পাশাপাশি দাফন করা স্থানের আশপাশ উপযুক্ত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কারও করতে বলা হয়েছে নির্দেশনায়। এ ছাড়া মৃত ব্যক্তি যে স্থানে মারা গেছেন সেই স্থানটিও যত দ্রুত সম্ভব জীবাণুমুক্ত করা এবং মৃতদেহ দাফনের পর সেই স্থান ভালোভাবে ঘিরে রাখতে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে নির্দেশনা অনুযায়ী, করোনায় সন্দেহভাজন কারও মৃত্যু হলেও সমান সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আইইডিসিআরে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এসে মৃত ব্যক্তির মুখের লালার নমুনা নিয়ে নিশ্চিত করবেন যে মৃত ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কি না। করোনা আক্রান্ত মৃতদেহ কখনোই ময়নাতদন্ত করা যাবে না।

এ বিষয়ে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেছেন, কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির সৎকার কীভাবে হবে, সে বিষয়ে এখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোনো প্রটোকল নেই। তবে ২০১৭ সালে ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্তদের মরদেহ সৎকারে ডব্লিউএইচওর তৈরি নিয়ম মেনে আইইডিসিআর একটা প্রটোকল তৈরি করেছে। এখানে ধর্মীয় সব বিধান মেনে চলা হয়।সে সময় ডব্লিউএইচও যে প্রটোকল করেছিল সেটাকে কিছুটা মোডিফাই করে একটা প্রটোকল তৈরি করেছি। তবে ইবোলায় মৃতদের দাফন-কাফনের নিয়ম আরেকটু কঠোর ছিল। ইবোলা আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে রোগটি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেশি। কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির নাকমুখ দিয়ে ফ্লুইডটা বের হয়ে ছড়াতে পারে। তবে সাবান দিয়ে ভালো করে গোসল করিয়ে নিয়ে জীবাণু অনেকটাই মরে যায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মরদেহ দাফন করা হবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায়। বিভিন্ন হাসপাতালের যারা এ কাজে যুক্ত তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার জন্যই আলাদা আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। সবই হবে প্রটোকল মেনে। মৃত ব্যক্তির পরিবার থাকলে আমাদের তত্ত্বাবধানে তাদের দাফন হবে। বেওয়ারিশ হলে তার দায়িত্ব দেওয়া হবে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামকে। কিন্তু আমরা যখন ডেডবডি হ্যান্ডওভার করব তখন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রটেকশন দেখা হবে।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বিশ্বে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত ২ লাখ ৮৪ হাজার ৭১২ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ১১ হাজার ৮৪২ জনের মৃত্যু সুস্থ হয়েছেন ৯৩ হাজার ৫৭৬ জন। এ ভাইরাসে দেশে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ২৪ জন। সুত্র; আমার সংবাদ

আমাদের বাণী ডট কম/২২ মার্চ ২০২০/আরসি 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।