মো.সাজ্জাদ হোসেন;  শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। আর মেরুদন্ড গড়ার কারিগর হল শিক্ষক। চিরন্তন সত্য বাক্য। জাতি, ধর্ম, বর্ণ সবার জন্য দরকার শিক্ষা। শিক্ষক সভ্য সমাজের ধারক। শিক্ষক সকল সভ্যতার ফুল ফোঁটায়। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থার ৯০ ভাগেরও বেশি পরিচালিত হয় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কিছু এমপিওভুক্ত। আবার কিছু নন এমপিওভুক্ত। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কিছু শিক্ষক কর্মচারি সামান্য অনুদান পায়। আর কিছু প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কিছুই পায় না।

সারা মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে, সকল প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে আন্তরিকতার সহিত শিক্ষা বিলিয়ে দেওয়ার পরও মাসের শেষে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের ভাগ্যে কিছুই জোটেনা। বাবা-মা,স্ত্রী-সন্তান তাদের কোন দাবি নন.এমপিও শিক্ষকের দ্বারা পূরণ করা সম্ভব হয়না। ধার দেনা করে দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে হয়। ঋণের বোঝায় জর্জরিত শিক্ষকের চোখে অন্ধকার দেখা ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যারা সামান্য অনুদান পায় তারা পরিবার পরিজন নিয়ে দু-বেলা দু-মুঠো খাবার খেয়ে কোন রকমে হয়ত বেঁচে আছে। সংসারের আয় এবং ব্যয়ের খাতার উদ্বৃত্ত সব সময় শুণ্য থাকে।

বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা একটি বৈষম্যের শিক্ষা ব্যবস্থা। চাকুরি আছে বেতন নাই। আছে সামান্য অনুদান। আবার সবার ভাগ্যে অনুদানটাও জোটেনা। যারা অনুদানভুক্ত শিক্ষক কর্মচারি তাদের নেই কোন প্রমোশন, নেই কোন বদলির সিস্টেম। একই প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর চাকুরি করতে হয়। বাবা মা পরিবার পরিজনকে রেখে চাকুরি করতে হয় দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। চাকুরি শেষে আবার শুণ্য হাতে বাড়ি ফিরতে হয়। অবসর এবং কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে যেটা পাওয়া যায় তা জীবিত থাকাকালীন সকল শিক্ষক ভোগ করে যেতে পারে না। সেটা হাতে পাওয়ার আগেই অনেক শিক্ষককে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়। এ বৈষম্য শুধুমাত্র শিক্ষক সমাজের নয়। সাধারণ গরীব কৃষক, শ্রমিকের সন্তানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যাদের শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের নেওয়ার কথা তাদেরকে উচ্চ-বেতন দিয়ে বেসরকারি ও প্রাইভেট স্কুল কলেজে পড়তে হচ্ছে।

বর্তমান শিক্ষক সমাজের সংগঠনভেদে ভিন্নতর দাবি পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাজপথে দাবি বস্তবায়নের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচিও দেখা যাচ্ছে। দাবির পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতেও প্রচার প্রচারণার কমতি নেই। সকল সংগঠনের কর্মকান্ড বিশ্লেষন করলে দেখা যায় যে, দাবিগুলো মূলত ৩ ধরনের।

১. এমপিওভুক্ত সকল প্রতিষ্ঠান একসাথে জাতীয়করণ। কিছু সংগঠন অবশ্য দাবি তুলেছিল সকল স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান        একযোগে জাতীয়করণ।
২. এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে বদলি বাস্তবায়ন।
৩. সবচাইতে করুণ এবং মানবিক যে দাবি,সেটা হলো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সকল প্রতিষ্ঠান একযোগে এমপিওভুক্তকরণ।

নিজেদের সম্মান মর্যাদার ক্ষেত্রে দাবির কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে। আবার আর্থিক, সামাজিক ও পারিপাশির্^ক আবস্থার পরিপেক্ষিতে দাবির ভিন্নতা থাকবে এটা হলফ করে বলা যায়।

শিক্ষক সমাজের মানবিক দাবিগুলো আকাশে বাতাস ধ্বনিত হয়ে আবার নিজেদের কাছে ফিরে আসে। বেসরকারি শিক্ষক সমাজের ক্রন্দন আকাশ বাতাসে ঘুরে ঘুরে দেশের কর্তাব্যক্তিদের হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারেনা। এটার জন্য বেসরকারি শিক্ষক সমাজের কষ্ট থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হল কৃষক ও শিক্ষকের অভাব অনটনের সার্বিক চিত্র কখনই কোন মানুষের হৃদয়কে ছুঁতে পারেনা। কৃষকের অন্ন মুখে তোলেনা এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আবার শিক্ষকের দেওয়া জ্ঞান বুদ্ধি ছাড়া বিশ^জয় করেছে এমন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আমরা প্রতিনিয়ত যাদের কাছে ঋণি তাদের কথা সবাই ভুলে যাই। আমাদের অতীতকে আমরা সবাই ভুলে যেতে চাই।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তৃণমূল থেকে উঠে আসা বিশ^নন্দিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক সুযোগ্য সন্তান। বাবার মত বিশাল হৃদয়ের অধিকারি।

আলজেরিয়ায় ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্ম্পকে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন-“ আমি হিমালয় দেখিনি,তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য। আর এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।”

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য সন্তান। বঙ্গবন্ধু দেশের জনগণের মনের কথা যেমন বুঝতেন তার সুযোগ্য কন্যাও বঙ্গবন্ধুর মত দেশের জনগণের কথা বোঝেন। বঙ্গবন্ধু যেমন শিক্ষকের কথা ভাবতেন তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাও দেশের শিক্ষক সমাজকে নিয়ে ভাবেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীন দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১,৬৫,০০০ প্রাথমিক শিক্ষকের চাকুরি জাতীয়করণ করেছিলেন। তার সুযোগ্য কন্যাও পিতার মত একযোগে ২৬,০০০ বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষকদের একপ্রকারের বৈষম্য দূর করেছেন।। ইতিমধ্যে দেশের প্রতিটি উপজেলায় স্বনামধন্য একটি করে স্কুল ও একটি করে কলেজ জাতীয়করণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২৭৩০ টি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির জন্য নাম ঘোষিত হয়েছে। বদলি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সকল সেক্টরের মানুষের মানবিক দাবিগুলো পূরণ করে চলেছে। সকল শিক্ষকমন্ডলী ভেবেছিল মুজিববর্ষ হবে শিক্ষকদের দাবি পূরণের বর্ষ। কিন্তু সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও করুণার মহামারির কারণে শিক্ষক সমাজের সকল দাবি  প্রতিয়মাণ হয়ে গেছে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালনের সমস্ত প্রস্তুতি থাকার পরেও তা স্থগিত করতে হয়েছে। এখন অপেক্ষা করতে হবে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের জন্য।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য নেতৃত্বে দেশের আর্থিক সামর্থ্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। দেশের বড় বড় প্রকল্পগুলো দেশীয় অর্থায়নে সমাপ্তির পথে। ২০২১ সালে খুলে দেওয়া হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। বিদ্যুৎ খাতসহ সকল ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। বেসরকারি শিক্ষকের দাবি পূরণের জন্য দেশের আর্থিক সামর্থ্যরে কোন ঘাটতি নেই। বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার পরিপেক্ষিতে সকল মানুষের দাবি দাওয়া পূরণ করে মানুষের মুখে হাঁসি ফোঁটানোর কাজটি সুসম্পন্ন করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। সকল প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলা করে বাংলাদেশের মানুষকে জীবন সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মানবতার মা। সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। করোনার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য আর্থিক ও মানুষিক ভাবে শিক্ষক সমাজের পাশে থাকবেন এটাই শিক্ষক সমাজের প্রত্যাশা। শুধুমাত্র মমতাময়ী নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি ঘোষণাই পারে শিক্ষকদের সকল বৈষম্য দূর করে উন্নত,আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে।

লেখক; প্রভাষক,হিসাব বিজ্ঞান, লাউর ফতেহপুর ব্যারিস্টার জাকির আহাম্মদ কলেজ, নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

আমাদের বাণী ডট কম/৩১ মার্চ ২০২০/পিএ 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।