চূড়ান্ত নাগরিকত্বের তালিকায় নিজের বা ঘনিষ্ঠ স্বজনদের নাম না ওঠায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ভারতের আসামের যে ১৯ লাখ হতভাগ্য মানুষ, তাদের মধ্যে চারজন বিবিসির কাছে তাদের ক্ষোভ এবং হতাশার কথা বলেছেন। এই চারজনের দুজন মুসলিম এবং দুজন হিন্দু। তাদের নিজেদের মুখেই শুনুন সে কথা –

শুকুর আলী, বরপেটা জেলার বাসিন্দা

প্রথমবার যখন এনআরসি হয়েছিল আসামে, তখন আমার বয়স ছিল দুই বছর। এবারের এনআরসি-তে নাম তোলার জন্য যখন লিগ্যাসি ডেটা বার করা হল, সেখানে দেখা গেল যে আমার নাম সেই প্রথম এনআরসিতে উঠেছিল। সেটা কত সাল বলতে পারব না, কিন্তু আমার যে দুই বছর বয়স ছিল তখন, সেটা তো সরকারি কাগজেই প্রমাণ। তবুও এবারের এনআরসি-তে আমার নাম নেই।

শুধু আমার না, ছেলে, নাতি-নাতনী কারোরই নাম নেই। তবে স্ত্রী আর দুই পুত্রবধূর নাম তালিকায় এসেছে। খসড়া তালিকা বেরনোর পরে চার বার আমাকে শুনানিতে ডাকা হয়েছিল ৫০ কিলোমিটার দূরের একটা শিবিরে। সেখানে অতবার গিয়েও নাম তুলতে পারলাম না!

এখন সবাই বলছে যে মামলা কর। কিন্তু তাতে তো পয়সা লাগবে! কোথায় পাব আমি অত পয়সা? আমার কি হাইকোর্ট – সুপ্রিমকোর্টে যাওয়ার সামর্থ্য আছে? মরে না যাওয়া ছাড়া তো আর কোনও উপায় দেখি না!

রাণী পাল, গুড়েশ্বর, বাকসা জেলা

আমি ১৯৬৫ সালে যে ভোট দিয়েছিলাম, সেই নথি জমা দিয়েছিলাম, তা সত্ত্বেও আমার নাম ওঠেনি এনআরসি-তে। কেন যে উঠল না সেটা এখনও বুঝতে পারছি না। আমার জন্ম এখানে হলেও আমাদের পরিবার আদতে বিহারের বাসিন্দা। আমাকে কীভাবে বাংলাদেশী মনে করতে পারে, সে তো বুঝতে পারলাম না।

বাপন মল্লিক, হাজলপাড়া, বাকসা জেলা

আমার ঠাকুরদা নীহার রঞ্জন মল্লিক আদতে ময়মনসিংহের বাসিন্দা ছিলেন। ১৯৬৪ সালের পয়লা জুলাই তিনি পরিবারসহ সীমানা পার করে ভারতে আসেন। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের গীতলদহ সীমানা চৌকি দিয়ে ভারতে এসে তিনি জলপাইগুড়ি জেলায় থাকতেন প্রথমে। তারপরে তিনি আসামে আসেন।

সেই ‘মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট’ জমা দিয়েছিলাম আমরা এটা প্রমাণ করতে যে ১৯৭১-এর আগেই আমার পূর্বপুরুষ ভারতে বসবাস করতেন। ওই সার্টিফিকেটে আমার বাবাসহ পরিবারের যতজন এসেছিলেন ভারতে, সকলের নাম রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের পরিবারের সাতজন সদস্যের কারও নামই এনআরসি-তে উঠল না।

অফিসাররা শুনানির সময়ে বলেছিলেন যে আমার টেনশনের কোনো কারণ নেই। আসল নথি আছে, তাই আমাদের নাম এসে যাবে। তবে তালিকা বেরনোর পরে তো দেখছি নাম নেই। আমাদের এলাকার মোটামুটি ৭০ শতাংশ মানুষেরই নাম ওঠেনি।

বাঙালিরা যাতে আসামে না থাকতে পারে, সেজন্যই চক্রান্ত হচ্ছে। যা ভোগান্তি হচ্ছে বাঙালিদের, যে অত্যাচার হচ্ছে, তার থেকে সরকার বলেই দিক যে বাঙালিরা আসামে থাকতে পারবে না! আমরা না হয় চলে যাব। অথবা মেরে ফেল আমাদের।

মানুষ নাওয়া খাওয়া ভুলে চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে এরপর কী হবে, সেটা ভেবে!

মুকাদ্দেস আলী, বরপেটার বাসিন্দা

আমার নাম ঘটনাচক্রে এনআরসি-তে এসেছে, কিন্তু আমার স্ত্রী বা ছেলে-মেয়ে কারও নাম ওঠেনি। কতো বড় অবাক কাণ্ড ভাবুন। আমি যদি ভারতীয় হই, তাহলে আমার ছেলে মেয়েরা কি বাংলাদেশী হবে? আমার স্ত্রীর নামও নেই। তার জন্ম এখানেই, তার গোটা পরিবার এদেশেরই, কিন্তু তাকেও কী তাহলে এখন বিদেশী বলা হবে? কেমন করে আমাদের পরিবারকে বিদেশী বানাবে?

গতবছরের খসড়া তালিকায় আমার নামও ছিল না। তারপরে সকলের নামেই নোটিস এল যখন, তখন বার বার শুনানিতে গেছি। বহু দূরে দূরে যেতে হয়েছে গাড়ি ভাড়া করে। সুদে দশ হাজার টাকা ধার করে নথি যোগাড় আর শুনানির জন্য গাড়ি ভাড়া করেছি আমরা। এত করেও নাম তুলতে পারলাম না। এখন যে কী করব, জানি না।

সরকার নাকি বলছে কোর্টে যেতে হবে। এমনিতেই এত টাকা ধার কর্জ হয়ে গেছে, এরপরে আবারও মামলা লড়তে হলে তো আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে যাব! আমাদের ক্ষমতা আছে নাকি হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।