অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিশ্ববাসীর কাছে কাশ্মীর ভূস্বর্গ হিসেবেই খ্যাত। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে অধিকৃত কাশ্মীর তো এক দগদগে ঘাঁ যা থেকে অবিরাম রক্ত ঝরছে। ভারতীয় শাসকদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রতিশ্রতি আসলেও বাস্তবে মিলেছে কেবল প্রতারণা আর বিশ্বাসভঙ্গের দীর্ঘশ্বাস। যে কারণে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে এ অঞ্চলের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা মানুষেরা। কিন্তু এইসব স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনো মূল্য দেয়নি শাসক শ্রেণি। এসব স্বাধীনতার সংগ্রামকে তারা আখ্যায়িত করেছে বিচ্ছিন্নতাবাদতী আন্দোলন হিসেবে। আর কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেয়া সাহসী বীরদের অসম্মানিত করা হয়েছে ‘জিহাদি’,‘জঙ্গি’বা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’হিসেবে। জঙ্গি দমন ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে সমানে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে কাশ্মীরি যোদ্ধাদের। ভারতীয় সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সাধারণ মানুষও। তাই এক দগদগে ক্ষতের নাম কাশ্মীর, যা থেকে অবিরাম রক্ত ঝরছে।

১৯৪৭ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অঙ্গ ছিল না। মহারাজা হরি সিং-এর অধীনে এখানে প্রচলিত ছিল স্বাধীন রাজতন্ত্র। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ২২শে অক্টোবর কিছু পার্বত্য দস্সুরা কাশ্মীর আক্রমণ করলে, রাজা হরি সিং ভারতের কাছে সেনা সাহায্য চান ভারতভুক্তির (ইনস্ট্রুমেন্ট অফ অ্যাকসেশন) শর্তে। তাতে জম্মু-কাশ্মীরকে ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসনের বিশেষ মর্যাদা দেবার ব্যবস্থা রাখা হয়। সে সময়ে বিনা পারমিটে কাশ্মীরে কেউ প্রবেশ করতে পারতো না। এই ৩৭০ ধারার মধ্যেই নিহিত আছে ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তিকরণের ইতিহাস।

১৯৪৮ ভারত জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করর পর ৪৭ ক্রমিক সংখ্যক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। ঐ প্রস্তাব অনুযায়ী গোটা কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিলো। কিন্তু পরে ভারত ওই প্রস্তাব থেকে সরে আসে। পাকিস্তান প্রস্তাব অনুযায়ী, কাশ্মীর থেকে সেনা অপসারণ করতে অস্বীকার করে৷ অতঃপর কাশ্মীরকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়।

১৯৫১ ভারতীয় কাশ্মীরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে সমর্থন করা হয়। এরপরই ভারত জাতিসংঘে গৃহীত গণভোট প্রস্তাবটি মানতে অস্বীকার করে। অন্যদিকে গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার দাবিতে অটল থাকে জাতিসংঘ ও পাকিস্তান।

১৯৫৩ কাশ্মীরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহ গণভোটের সমর্থক ছিলেন ও ভারতের কাশ্মীর দখলকে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। ফলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর জম্মু-কাশ্মীরের তাবেদার সরকার ভারতের কাশ্মীর দখলকে পাকাপোক্ত করেন। এর কয়েক বছর পর ১৯৫৭ সালে ভারতের সংবিধানে জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতের অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

১৯৬২-৬৩ ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন আকসাই দখল করে। তার আগের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স কারাকোরাম ট্র্যাক্ট এলাকাটি চীনকে প্রদান করে। ভারতের কাশ্মীর দখলকে কেন্দ্র করে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়। কিন্তু যুদ্ধশেষে দুই দেশের সেনারা তাদের পুরোনো অবস্থানে ফিরে যায়৷

১৯৭১-৭২ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আবারও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ভারত ও পাকিস্তান। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালে। যুদ্ধবিরতি রেখাকে লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিণত করা হয় ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ সমাধানে সম্মত হয় বিবাদমান দুই দেশ।

১৯৮৪ ভারত সিয়াচেন হিমবাহ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার পর পাকিস্তান তা একাধিকবার দখল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি।

১৯৮৭ জম্মু-কাশ্মীরে বিতর্কিত নির্বাচনের পর রাজ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু ভারত কাশ্মীরি জনগণের এই স্বাধীনতার স্পৃহাকে অগ্রাহ্য করে এবং উল্টো এসব যোদ্ধাদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’আখ্যা দেয়। আর এইসব আন্দোলনে সমর্থন দেয়ায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থাকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ আনে। কিন্তু পাকিস্তান ভারতের এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে।

১৯৯০ গওকাদল সেতুর কাছে ভারতীয় সিআরপি রক্ষীবাহিনী কাশ্মীরি বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালে পর শতাধিক আন্দোলনকারী নিহত হন। তখন প্রায় সমস্ত হিন্দু কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে যায়। জম্মু-কাশ্মীরে সেনাবাহিনীকে আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট (আফসা) অনুযায়ী বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়।

১৯৯৯ গোটা নব্বই-এর দশক ধরে আন্দোলনে প্রকম্পিত হয় কাশ্মীর উপত্যকায়। এই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করেই ১৯৯৯ সালে কারগিলে যুদ্ধে লিপ্ত হয় ভারত-পাকিস্তান।

২০০১-২০০৮ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলাপ-আলোচনার যাবতীয় প্রচেষ্টা প্রথমে নতুন দিল্লির সংসদ ভবন ও পরে মুম্বাই হামলার ফলে ব্যর্থ হয়।

২০১০ ভারতীয় সেনার গুলিতে এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর পর উত্তেজনায় ফেটে পড়ে অধিকৃত কাশ্মীর। বিক্ষোভ চলে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে, প্রাণ হারান অন্তত ১০০ জন।

২০১৩ ভারতীয় সংসদ ভবনে হামলার মুখ্য অপরাধী আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এর পর যে বিক্ষোভ চলে, তাতে দু’জন প্রাণ হারায়। এই বছরই ভারত আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় মিলিত হয়ে উত্তেজনা উপশমের কথা বলেন।

২০১৪ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ উপস্থিত হন। কিন্তু এর পর নতুন দিল্লিতে পাকিস্তানি হাই কমিশনার কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার অজুহাতে ভারত আলাপ-আলোচনা স্থগিত রাখে।

২০১৬ আজাদ কাশ্মীর ভিত্তিক হিজবুল মুজাহিদীন-এর অধিনায়ক বুরহান ওয়ানি-র মৃত্যুর পর কাশ্মীরে স্বাধীনতা সমর্থকরা আবার পথে নেমেছে। এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ জন নিহত হয়েছে। এখনও বিক্ষোভ অব্যাহত আছে।

২০১৯ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামা সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর গাড়িবহরে বোমা হামলা হয়। এতে ৪২ জওয়ান নিহত হন। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জৈশ-ই-মোহাম্মদ হামলার দায় স্বীকার করেছে। এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী।

২২ জুলাই

এদিন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে বৈঠককালে ট্রাম্প কাশ্মীর ইস্যুতে মধ্যস্থতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। গত ২২ জুলাই, সোমবার ওভাল অফিসে ইমরানের পাশে বসেই ট্রাম্প মধ্যস্থতার কথা তোলেন। ইমরান প্রথমে বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু হওয়া দরকার।’

সে কথার সূত্র ধরেই ট্রাম্প বলেন, ‘দু’ সপ্তাহ আগে মোদির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি জানতে চান, আমি মধ্যস্থতা করতে রাজি কি না। আমি প্রশ্ন করি, কোন বিষয়ে? তিনি বলেন, কাশ্মীর। কারণ, বিবাদটা অনেক দিন ধরে চলছে। আমি তখন তাকে জানাই, মধ্যস্থতা করতে পারলে আমি খুশিই হব।’

ট্রাম্পের এ বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ইমরান বলেন, ‘এটা হলে ১০০ কোটি মানুষের শুভেচ্ছা আপনার সঙ্গে থাকবে।’

ট্রাম্পের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে দ্রুত প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর। আর ট্রাম্পের এই বক্তব্যের মাত্র ১০ দিনের মাথায় কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিলো ভারত।

২০১৯, ৫ আগস্ট

এই দিন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংবিধানের ৩৭০ ধারাটি বিলোপের দাবি তোলেন। রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে পাস হয় বিলটি। একই দিনে তাতে স্বাক্ষর করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷ ফলে, কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’ এখন আইনত বাতিল হবার পথে। এই ধারাটি বাতিল করার আগে গত ৪ আগস্ট গোটা কাশ্মীর জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয় স্কুল-কলেজ। গণহারে গ্রেপ্তার করা হয় কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের।

এতদিন ধরে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং ধারার জেরে বিশেষ মর্যাদা পেত রাজ্যটি। ফলে জম্মু ও কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শীর্ষ ক্ষমতা ছিল রাজ্য সরকার ও বিধানসভার হাতে। কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের কোনো স্থান ছিল না।

এই ৩৭০ অনুচ্ছেদের সুবাদে কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দারাই শুধুমাত্র সেখানে বৈধভাবে জমি কিনতে পারতেন, সরকারি চাকরি করার সুযোগ পেতেন এবং সেখানে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন। এমনকি সেখানকার নারীরা কোনো অ-কাশ্মীরি পুরুষকে বিয়ে করলে তারা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। এতটাই কঠোর প্রয়োগ ছিল এ ধারাটির।

এখন এই ধারা রদ করার পর সেইসব বাধা পুরোপুরি উঠে যাবে। এরপর ভারতের অন্যান্য স্থানের হিন্দুরা পঙ্গপালের মত ছুটে আসবে উপত্যকার দিকে। অর্থের জোরে তারা দখল করবে নিঃস্ব দরিদ্র কাশ্মিরীদের পৈত্রিক ভূমির অধিকার। বলাবাহুল্য, ভারতীয় সেনাদের নির্যাতন ও নানা বৈষম্যের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই অবদমিত উপত্যকার জনতা।

গোটা কাশ্মীর উপত্যকাকে বিচ্ছিন্ন করে এবং এর জনগণকে অন্ধকারে রেখে এই বিশেষ ধারাটি বাতিল করেছেন অমিত শাহ। এখনও গোটা বিশ্বের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে কাশ্মীরের বাসিন্দারা। ফলে এখনও অনেকেই জানেই না তাদের ভাগ্যে কতবড় দুর্যোগ নেমে এসেছে। বলাবাহুল্য মোদি সরকরের এই চক্রান্ত যখন তারা জানবে তখন আবার বরুদের মত জ্বলে উঠবে গোটা উপত্যকা। কাশ্মীরি জনতার সেই ক্রোধ কীভাবে দমন করে মোদিশাহীরা সেটাই দেখার বিষয়। হয়তো গোলাবারুদ, অস্ত্র, মর্টার আর সাঁজোয়া যানই হবে কাশ্মীরিদের এই ক্রোধ নিবারনের একমাত্র অবলম্বন, যার ফেরে আরও রক্ত ঝরবে ভূ-স্বর্গের সোনালি জমিন জুড়ে। হয়তো ক্ষমতার দর্পে বলিয়ান দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতেই একদিন বিশ্বের বুক থেকে নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাবে একটি জাতি ও সংস্কৃতি। নয়তো উপত্যকার রুক্ষ পাহাড়ের বুকে টিকে থাকবে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর পরিচয়ে। কে জানে সামনে কি কঠিন সময় অপেক্ষা করছে ভূস্বর্গের বাসিন্দাদের জন্য!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।