পৃথিবীর অন্যান্য বহু দেশের মতোই বাংলাদেশও কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে স্বীকৃত। বিভিন্ন প্রকার কৃষিপণ্যের মধ্যে ধানই প্রধান পণ্য এবং বাঙালির খাদ্যতালিকায়ও ভাতই প্রধান খাদ্য হিসাবে বিবেচিত। খাদ্য বিজ্ঞানীদের মতে, ভাতের বিকল্প আলু হলেও সেটা গ্রহণ করেছে ইউরোপবাসী, বাঙালি নয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরা চেষ্টা করেছে বাঙ্গালীদের ভাতের বিকল্প ভুট্টা বা রুটি খাওয়ানোর জন্য। পারেনি ব্যর্থ হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে আটক রেখে, ভাতের পরিবর্তে জোরপূর্বক রুটি খাওয়াতেও ব্যর্থ হয়েছে। যদিও তারা চেষ্টা কম করেনি। পোকা পড়া ভাত দিত যাতে তিনি না খান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ওই ভাতের মধ্য থেকে পোকা বেছে ভাত খেয়েছেন, তবুও রুটি খাননি। এজন্য বাঙালিকে বলা হয়ে থাকে, ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। এবং শহরের কিছু ধনী শ্রেণী বাদে গ্রামের অসংখ্য গরিব কৃষক-শ্রমিকরা, এখনো পেঁয়াজ কাঁচামরিচ ভেঙ্গে পান্তাভাত খায়। এটি বাঙালির একটি ঐতিহ্যও বটে। সতোরো’শ শতাব্দী থেকে আমাদের ভারতবর্ষের কৃষ্টি। এবং আজকের পুষ্টিবিজ্ঞানীরাও গবেষণা করে জানিয়ে দিলেন যে, গরম ভাতের চেয়েও পান্তা ভাতের পুষ্টি বেশি। সেটি সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হতে হবে।

গাজীপুরে একটি টেক্সটাইলে চাকরি করার সুবাদে একজন পাকিস্তানীকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তিনি ওই টেক্সটাইলের ডিজিএম। তার মুখের একটি বকা শ্রমিকদের মুখে মুখে ছিল। তিনি বাঙ্গালীদের গালি দিতেন, মাছে-ভাতে বাঙালি শালা মাছ খাওয়া জাত’। তো আজ, লবন- কাঁচামরিচ পেঁয়াজ কোনো রকম জুটলেও জোটে না এক টুকরো ইলিশ, জাতির জাতীয় মাছ। ওটা শহরের বড় বাবুদের খাদ্যতালিকায় স্থান করে নিয়েছে। আর পহেলা বৈশাখে পাওয়া যায় রমনার বটমূলে। গরম ভাতে জল ঢেলে সঙ্গে ইলিশ নিয়ে এক দিনের বাঙালি সাজা। হাতে কাস্তে, মাজায় লাল গামছা বেঁধে, মাথায় মাথাল দিয়ে লুঙ্গি পড়ে স্বনামধন্য ধনীও সেদিন কৃষক সেজে গিয়েছেন। দেখতে ভালোই লাগে কৃষককে নিয়ে এসব ব্যঙ্গ করা। কেননা, মনে হয় না বাবুদের সোফায় বা ডাইনিং টেবিলে সত্যিকারের কৃষকের কোন স্থান হবে। এজন্য যে, তাদের গায়ে তো সব সময় প্যাঁক কাদার গন্ধ লেগে থাকে! আবার রোদ্রে পুড়ে তারা হয়ে যায় বেগুন পোড়ার মতো কালো। তো জগতে কালোর কি কোনো মূল্য আছে? নেই; কিন্তু আছে।

যদিও সেটা সবাই উপলব্ধি করতে পারেন না। কেননা, কালোর মধ্যেই আলো লুকায়িত। দুর্ভাগ্যক্রমে এ আলো সবার আঁখিতে মেলে না। যার জন্য কালোর কদর কম। ধান থেকে ভাত হয় এবং ধানের উৎসদাতা কৃষক। আর এই কৃষক তার ফসল ফলিয়ে সবার মুখে অন্ন জুটিয়ে থাকলেও, অনেক সময় দেখা যায় কৃষকই অন্ন বিনে অনাহারে মৃত্যু বরণ করছে। সেটা কোনো দুর্ভিক্ষে হোক বা প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগেই হোক না কেন। কৃষক সবার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারলেও নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেনি। পারার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না আপাতদৃষ্টিতে। মূলত এর জন্য দায়ী পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা। সঠিক গণতন্ত্র চর্চার স্বার্থে সরকারের শক্তিশালী বিরোধী দলের কোনো বিকল্প নেই, তাও সেটা সরকারি দলের স্বার্থেই। এবং সে বিরোধী দল হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিরোধী দল; যা আজ অনুপস্থিত। তা না হলে, কৃষকের এ বিলাপ আজ জাতিকে শুনতে হতো না। কিন্তু যেভাবেই হোক, এখান থেকে কৃষককে উত্তলনের ব্যবস্থা করতেই হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ বইয়ের, ‘বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্যে উন্নয়ন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “আন্দোলন হবে সমাজ সংস্কারের জন্য, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। আর এ উন্নয়ন মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য নয়। এ উন্নয়ন অবশ্যই হতে হবে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য। সমাজের অধিকাংশ মানুষ যারা বঞ্চিত, জীবনের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে পারে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বঞ্চিত একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই থেকে বঞ্চিত কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে। আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। এই সম্পদ কেউ যদি বেশি পরিমাণে দখল করে তাহলে অন্য কেউ বঞ্চিত হয়। তার ভাগে কম পড়ে। কাজেই সম্পদের সুষম বন্টন প্রয়োজন। কেউ খাবে কেউ খাবে না তা হবে না। সকলের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠত হতে হবে। রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে”। আমরা বলব, নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে সর্ব মহলের কাছে গণ্য হবে তখন, যখন এটি শতভাগ বাস্তবায়িত হবে। আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব এটি বাস্তবায়িত হোক জাতীয় স্বার্থে। রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই।

গণতান্ত্রিক দেশে, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কুলি-মজুরদের বিভিন্ন সংগঠন থাকে বা আছেও। শুধু নেই কৃষকদের কোনো সংগঠন। যে সংগঠনের মাধ্যমে কৃষক তার বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরবে এবং সেটা আদায় করে নেবে। দর কষাকষি না করে কেউ ন্যায্যমূল্য পায় না বা শাসকগোষ্ঠী কখনোই তা দেয় না। নামমাত্র কৃষকদের জন্য কৃষকলীগ থাকলেও বাস্তবে তা অকেজো। সরকারের আমলাদের স্বার্থে যদি কোন আঘাত লাগে, তখন তাঁরা সঙ্গে-সঙ্গে উঠে পড়ে লেগে যান এবং সরকার তাঁদের দাবি-দাওয়া মিটিয়েও দেন সঙ্গে-সঙ্গে। বাস-ট্রাকের শ্রমিক সংগঠন যদি অবরোধের ডাক দেয়, তাহলে বাংলাদেশ যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। ফলে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জরুরী মিটিং ডেকে তা নিরসন করার চেষ্টা করেন। শিল্পপতিরা তাদের যেকোনো পণ্যের মূল্য তারা নিজেরাই নির্ধারণ করেন, কিন্তু কৃষকের পণ্যের মূল্য কৃষক নির্ধারণ করতে পারেন না! কারণ একটাই, সেতো গরিব! তার আবার কিসের চাওয়া-পাওয়া! অতএব, ধনীরা যা দেয় তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে হবে। কৃষকের জন্ম তো আর সোনার চামচ মুখে দিয়ে হয়নি যে, সে গোমড়া মুখে চেয়ে থাকবে। তার জন্ম হয়েছে বিলের ঝিনুক মুখে দিয়ে। কাজেই কৃষক তার ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে ক্ষেতে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। কেননা, তার কথা তুলে ধরার মতো কেউ নেই। অতএব এটাই হয়তো তার প্রতিবাদের ভাষা। কিন্তু এটা কাঙ্খিত নয়, এটা অনাকাঙ্ক্ষিত হওয়াও উচিত নয়! বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’র ১৪ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, “রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে- এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা”। সমাজের বাস্তব চিত্র দেখে মনে হয়, পূর্বে উল্লেখিত উক্তিখানা পবিত্র সংবিধানের জন্যই প্রযোজ্য, বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগে নয়!

গুলশানে ‘সিপিডি’র একটি অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ‘ধনী-গরীবের’ বৈষম্য কমাতে হবে”। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, “আমাদের সংসদে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় তাতে প্রান্তিক জনগণের উন্নয়নের কথা খুব কম। মাত্র তিন মিনিট হয় গরীব মানুষের কথা বাকি সময় জুড়ে অন্যান্য আলোচনায় ব্যস্ত থাকে সংসদ। বর্তমান সংসদ গরীব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে না”। সিপিডি’র বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, “ধনী-গরীবের বৈষম্য যেন বৃদ্ধির না পায় সেদিকে নজর দিতে হবে”। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আমরা আনন্দে বেশ লাফ-ঝাপ পারছি। আসলে পুঁজিবাদীদের এটি একটি ভাঁওতা ছাড়া কিছু নয়। কেননা, এটা তো সমাজতন্ত্র নয়, ধনতন্ত্র। এখানে সম্পদ বৈষম্যের পাশাপাশি আয় বৈষম্যও রয়েছে ব্যাপক! কোটিপতির পাশাপাশি বাস্তহীনও রয়েছে। কিন্তু জরিপের সময় কোটিপতির অর্থ বাস্তহীনের উপর চাপিয়ে দিয়ে জরিপ চালানো হয়। তো এটা কি ভাঁওতা নয়? মেনে নেওয়া যেত যদি আয় বৈষম্য ঠিক মতো থাকতো।

আন্তর্জাতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ধনীর ধন বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই, কমেছে দরিদ্রের সম্পদ। ধনকুবের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে দিয়েছে! গত পাঁচ বছরে দেশে অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে ১৭ শতাংশ হারে। এ হার যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ ৭০টি বড় অর্থনীতির দেশের হারের চেয়ে বেশি। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, শুধু আয় বৈষম্যই নয়, সম্পদ বৈষম্যও ব্যাপক! বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর, ‘খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ’ তাঁর, ‘বৈষম্য কমানোর ব্যবস্থা নেই’ নিবন্ধে লিখেছেন, “এবারের বাজেটে আমাদের বড় একটা আশা ছিল যে, অর্থনৈতিক বৈষম্য বা আয়বৈষম্য নিরসনের জন্য বাজেটে বিশেষ কিছু বিষয় থাকবে বা কিছু করা হবে, সেটা করা হয়নি। এটা গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, আমাদের দেশে বৈষম্য মাপার জন্য যে পরিমাপক, সেটাকে বলে-গিনি, সহক; সেটি ৪.৯। যা উচ্চ বৈষম্য নির্দেশ করে। আমরা আশা করেছিলাম যে এটাকে কমিয়ে আনা হবে”। আমরাও আশা ছাড়িনি, অধির আগ্রহে বসে আছি তা কখন কমিয়ে আনবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। ২৩-৬-১৯ তারিখে একটি দৈনিকের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘বিলাসী জীবন তবু ঋণ শোধ করেন না তাঁরা’। তাতে দেখা যায়, দেশের প্রথম সারির স্বনামধন্য ব্যক্তিরা ঋণখেলাপি আছেন এবং ২০১৮ সালে প্রায় বারোশো কোটি টাকার সুদ মওকুফ পেয়েছে ধনীরা ধনী হওয়ার লক্ষ্যে। আমরা সরকারকে বলব, কৃষককে স্বল্পসুদে ঋণ দিন। ঋণ বা সুদ মওকুফ করতে হলে তা কৃষককে করুন, ব্যাংক অথবা কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়। কৃষককে ভুলে যাবেন না।

বঙ্গবন্ধু তাঁর, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন, “সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের মন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না”। বঙ্গবন্ধু যে অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যহীন আয়ের দেশের স্বপ্ন দেখতেন, আমরা চাই বাংলাদেশের স্থপতির অসংখ্য স্বপ্নের সঙ্গে এই স্বপ্নটাও বাস্তবায়িত হোক। সরকার ব্যাংক খাতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দেয়, কিন্তু ব্যাংক বা ধনী বান্ধব সরকার না হয়ে যদি কৃষি বা কৃষক বান্ধব সরকার হতো; দেশের জন্য ততই মঙ্গল হতো। সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা হয় নামমাত্র। সরকার মূলত ধান বা চাল কেনেন মিলারদের কাছ থেকে। ফলে কৃষক পড়ছেন ফাঁকিতে। এটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশে চাল থাকতেও বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে হয় মাঝে মাঝে, যা সংবাদপত্রে প্রকাশিত। এটি কাম্য নয়। শিক্ষক, ছাত্র, সাংবাদিকসহ স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে কৃষকের ধান কেটে ঘরে তুলে দেয়া কোন স্থায়ী সমাধান নয়। এবং এই করুণা দেখানোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না! কেননা, সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে, ‘রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি’র ১০ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, “মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে”। অতএব এটি বাস্তবায়িত হোক। পবিত্র সংবিধান বুকে নিয়ে জাতি অধীর আগ্রহে বসে আছে, কখন তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হবে, ক্ষুদার্থ জাতি যে ব্যাকুল প্রায়।

প্যাকেটজাত কৃত্রিম খাবার যে আমরা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার হিসাবে খাচ্ছি তা কিন্তু নয়। অস্বাস্থ্যকর হওয়ার কারণে নামি- দামি ব্যান্ডের ৫০ টি পণ্য বাজার থেকে উঠিয়ে নিতে কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন মহামান্য হাইকোর্ট। প্যাকেটজাত যেকোনো কৃত্রিম খাদ্যে ব্যবহৃত হয় বিষাক্ত কেমিক্যাল, টেক্সটাইলের কাপড়ের রং, ইটের গুড়া, কাঠের গুড়া, কাগজ, টিস্যু পেপারসহ ইত্যাদি খাদ্য নামক অখাদ্য। ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের লিভার, কিডনি, হুৎপিণ্ড বিকল হয়ে যায়। গর্ভবতী মায়েদেরও ক্ষতি হয়, গর্ভস্থ ভ্রূণের ক্ষতিসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার হাঁপানি ও এলার্জির রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। এ জন্য মূলত দায়ী ধনবাদী স্বার্থেন্বেষী অসাধু ব্যবসায়ী মহল! এদেরকে শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানা করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ জমিয়ে লাভ হবে না বা এটি কোন স্থায়ী সমাধান নয়। এখানে প্রশাসনের ভূমিকা হতে হবে কঠোর! অসাধু ব্যবসায়ী হিসেবে যদি কেউ প্রমাণিত হয়, তবে তার ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল করতে হবে এবং তার নামে দ্বিতীয়বার আর কোনো লাইসেন্স এর আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না।

কৃত্রিম খাদ্য বাদে প্রাকৃতিক যে কোনো খাদ্য উৎপাদনে কৃষকের ভূমিকা অনন্য। শুধু কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য নয়, প্রতিটা মানুষেরই সুস্বাস্থ্যের সঙ্গে জীবনযাপন করতে হলে, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হলে, সবার স্বার্থে কৃষকের দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষকই মানুষকে সুস্থ রাখতে পারে এবং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতেও পারে। সেটা তার অজ্ঞতার কারণ। যেমন ধরুন, এমনিতেই বাংলাদেশ আয়তনে ছোট্ট রাষ্ট্র। লোক সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে জ্যামিতিক হারে। এজন্য বনাঞ্চলসহ আবাদি কৃষি জমি নষ্ট করে গৃহ নির্মাণ করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। তাই স্বাভাবিক কারণেই খাদ্য ঘাটতি পড়ে এবং তার চাহিদাও ব্যাপক। এজন্য যেকোনো খাদ্যই সরাসরি প্রকৃতি থেকে আর আসছে না। ফলে বিষাক্ত কেমিক্যাল বা রাসায়নিকের মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে অনেক খাদ্য উৎপাদন করতে হচ্ছে শ্রম দিয়ে। আর এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছেন কৃষক। আর এই কৃষকের অজ্ঞতার কারণে আমরা উৎপাদিত সকল খাদ্যেই সরাসরি বিষাক্ত মাত্রায় ফরমালিনসহ কীটনাশকের উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি অস্বাভাবিক হারে।

১৮-২-১৯ তারিখে একটি দৈনিকের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘বিষের খনি বিশবাড়ি’। তাদের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, ক্ষেতের সার কীটনাশক ঝুঁকছে মানবদেহে। ধান, শাক-সবজি, মাছ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগিতেও ঢুকছে নানা ধরনের বিষ, খাদ্যচক্র হয়ে সেই বিষ ঢুকে পড়ছে মানুষের দেহে, তৈরি হচ্ছে জটিল রোগ। আর এই অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে উদ্ভুদ্ধ করছে কীটনাশক বাজারজাত প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা, কৃষকের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে! ৩-৩-১৯ তারিখে একটি দৈনিকের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘মাটি পানি হয়ে চালেও বিষ’। তাতে লক্ষ্য করা গেছে, রাসায়নিক সার কীটনাশক আর শিল্পবর্জ্যে দূষিত হচ্ছে মাটি পানি, খাদ্য চক্রের মাধ্যমে মানবদেহে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিডনি, লিভার, মস্তিষ্ক ক্যান্সারসহ নানা রোগবালাই। মানুষের জন্য বিপদজনক ভারী ধাতু। ২৩২টি নমুনা সংগ্রহ করে চালের উপর গবেষণা চালানো হয়। তাতে দেখা যায়, ১৩১টিতে বিভিন্ন মাত্রায় ক্রোমিয়াম। ১৩০টিতে ক্যাপসিয়াম ও সিসা। ৮৩টিতে আর্সেনিকের অস্তিত্ব মিলেছে। দৈনিক ‘কালের কন্ঠে’ প্রকাশিত, সরকারের জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, “গরুর খোলা দুধে অণুজীবের সহনীয় মাত্রা সর্বোচ্চ থাকার কথা ৪, অথচ পাওয়া গেছে ৭.৬৬ পর্যন্ত। আফলাটক্সিনের সহনীয় মাত্রা ০.৫, পাওয়া গেছে ০.৯৯৬ পর্যন্ত। টেট্রাসাইক্লিনের মাত্রা ১০০ পর্যন্ত সহনীয় কিন্তু পাওয়া গেছে ৬৭১.১৩ পর্যন্ত। সিপ্রোফ্লোক্সাসিনের মাত্রা ১০০ পর্যন্ত সহনীয়, কিন্তু পাওয়া গেছে ১৪৮.৩৬ পর্যন্ত। কীটনাশকের মাত্রা ৫ সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ৯.৫০-১৬.২০ পর্যন্ত”।

উল্লেখিত তথ্য অনুসারে, তাহলে আমরা কি বিষমুক্ত কোনো খাদ্য খেতে পারছি? না। অতএব জাতীয় স্বার্থে কৃষকদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কিভাবে তারা বেশি-বেশি ফসল উৎপাদন করবে এবং কীটনাশক রাসায়নিক বাদে, জৈব সার বা প্রাকৃতিক উপায়ে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য বা ফসল উৎপাদন করবে। বাজারে এমন সব কীটনাশক আছে যে, তার বিষক্রিয়া সহজে ধ্বংস হয় না। এমনকি শাক সবজিতে বিষ প্রয়োগ করার বেশ কিছুদিন পরেও সে শাকসবজি আগুনে সিদ্ধ করলেও বিষক্রিয়া থেকেই যায়। কৃষক যখন ফসলে বিষ প্রয়োগ করেন, বাতাসের সঙ্গে সেই বিষ মাইলের পর মাইল যেতে থাকে। তবুও তার বিষক্রিয়া ধ্বংস হয় না এবং তা শাসনালির মাধ্যমে মানবদেহে ঢুকে পড়ে। কৃষক বিষ প্রয়োগ করবেন কখন, কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে এবং বাতাসের উল্টো দিকে না সোজা দিকে দাঁড়িয়ে সে বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ কৃষকের নেই। কিন্তু এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া অত্যন্ত জরুরি। এজন্য কৃষিখাতে ভর্তুকিসহ কৃষি গবেষণায় পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন আমাদের। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, “প্রাণী ও উদ্ভিদের ৮০ লাখ প্রজাতির মধ্যে ১০ লাখই বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে। এর মধ্যে অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে কয়েক দশকের মধ্যেই” এবং তারা আরো বলেছে যে, “বিগত ১০০ বছরে নব্বই শতাংশের বেশি শস্যের জাত কৃষকের মাঠ থেকে হারিয়ে গেছে এবং গৃহপালিত অনেক প্রাণীর প্রায় অর্ধেক আজ বিলুপ্ত”। বিজ্ঞানীরাও সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, “এখনি কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে খোদ মানব প্রজাতির অস্তিত্বই হুমকিতে পড়ে যাবে”। মানুষ প্রকৃতির একটি অংশ হয়েও পুঁজিবাদের খপ্পরে পড়ে সে প্রকৃতিকে হত্যা করছে। কাজেই আমাদের সরকারর এদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া উচিৎ বলে আমরা মনে করি

চাষাবাদ ছাড়াই অনেক শাকপাতাই এমনি-এমনি প্রকৃতি থেকেই আসতো। যা স্বাস্থ্যসম্মত সবজি হিসেবে ছিল আমাদের খাদ্যতালিকায়। আজ বলা চলে ওগুলো বিলুপ্ত প্রায়। অধ্যাপক বিধান চন্দ্র দাস তাঁর একটি নিবন্ধ লিখেছেন,
“নলিতা, শান্তি, নটে, থানকুনি, আমরুল, নুনিয়া, কানাই, শিয়ালমুতি, চরগাদ, দুরমা, দুধলি, পিপুল, গিমা, খারকোন, বনঝুড়ি, কস্তুরি, মুনসি, পুনকো, ইছা, নিলিচি, হুটকা ইত্যাদি আরো কত শাকসবজি। বর্তমানে এসব শাক খাওয়ার প্রচলন প্রায় উঠেই গেছে অথচ স্বাস্থ্যের জন্য এগুলো খাওয়া যে কত প্রয়োজনীয়, বর্তমানে তা বিজ্ঞান পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি ও ঔষধি গুণ বিচারে এগুলোর মূল্য অপরিসীম। এগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন”। কীটনাশক ও রাসায়নিক সার পরিবেশের জন্য ক্ষতি হলেও কৃষক নিরুপায় হয়েই তা ব্যবহার করছে এবং উল্লেখিত প্রাণী উদ্ভিদ হত্যার পেছনে কীটনাশকেরও যথেষ্ট ভূমিকা আছে।
চাউল, ডাল, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, জল, শাকসবজি তরিতরকারিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় যেকোনো দ্রব্যই, এমনকি বাতাস পর্যন্তও ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশকে দূষিত! ফলে মানবপ্রজাতি আজ বিভিন্ন রোগে জরাজীর্ণ। আর এ কারণে বাজেটের একটা বড় অংশ সরকারের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দিতে হয়। তাই আমরা বলব, গোড়ায় গলদ রেখে কোন কাজেই সফলতা আশা করা যায় না। মানুষ প্রকৃতিরই একটি অংশ বা প্রজাতি। কাজেই প্রয়োজনীয় অর্থ কৃষি খাতে বরাদ্দ দিয়ে মানুষের স্বার্থে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে।

জেলা ভিত্তিক চাষাবাদ করার লক্ষ্যে আলাদা একটি কৃষি মনিটরিং ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাদের মাধ্যমে কোন জেলার মাটির ধরন কি তার বিচার করে চাষীকে সেই মোতাবেক সহায়তা করতে হবে। কেননা, একেক জেলার মাটির ধরন একেক রকম, সব জমিতে ফসল ফলে না। যেমন, কোনো জেলায় আলু, কোনো জেলায় আঁখ, কোনো জেলায় পেঁয়াজ-রসুন, কোনো জেলায় ধান-গম, কোনো জেলায় ভুট্টা-জব, কোনো জেলায় সরিষা, কোনো জেলায় আম, লিচু, আনারস, কোনো জেলায় সিম-বডবডি, টমেটো, বেগুন, ইত্যাদি শাকসবজি ভালো জন্মে মাটির গুণে। কাজেই আমরা চাই মাটি নির্বাচন করে, গবেষণা চালিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে কৃষককে বাঁচিয়ে তুলতে হবে। কৃষক বাঁচলে তবেই দেশ বাঁচবে এটা যেন আমরা উপলব্ধি করতে পারি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের এখানে দেখা যায়, যেমন প্রয়োজনের তুলনায় অধিক পরিমাণে পেঁয়াজ জন্মানো হয়েছে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই পেঁয়াজের দাম কমে যায়, যা চাষীর উৎপাদন খরচের চেয়েও অনেক কম। আবার দেখা যায় ওই বছরই রসুনের দাম আকাশ ছুঁই ছুঁই। কেননা, রসুন চাহিদার তুলনায় একেবারেই কম। আর সরকার যদি ঐ মনিটরিংয়ের মাধ্যমে কৃষককে বলে দেন যে, আপনারা এই জেলায় এই ফসল ফলান এবং এই ফসল ফলাবেন না। তাহলে কৃষকও যেমনি বাঁচবে তেমনি বাজারও স্থিতিশীল থাকবে, আর আমাদের খাদ্যেরও কোনো ঘাটতি পড়বে না।

আমরা পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই সেটা হলো, তামাক চাষে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা যাবে না ও কৃষি ঋণও দেয়া যাবে না। যদিও ধনবাদীদের ব্যক্তি স্বার্থেই কৃষককে তামাক চাষে পর্যাপ্ত সহায়তা করা হয়। ফলে কৃষকও তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ হয়। শুধু যে ধূমপানেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তা নয়। তামাক চাষেও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। চাষিসহ তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও এই ক্ষতির সম্মুখীন হন এবং গর্ভস্থ সন্তানও এই ক্ষতির সম্মুখীন থেকে রেহাই পায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাকের কারণে পৃথিবীতে প্রতিবছর ৭০ লক্ষাধিক মানুষ অকালে মারা যায়। টোব্যাকো অ্যাটলাসের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত অসুখে মৃত্যুবরণ করে। ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ছিল,”তামাকে হয় ফুসফুস ক্ষয়, সুস্বাস্থ্য কাম্য তামাক নয়”। কাজেই সরকারের কাছে আমাদের সবিনয়ে অনুরোধ, শুধু স্লোগানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, জাতীয় স্বার্থে তা বাস্তবায়ন করুন।

লেখক: লাইব্রেরীয়ান, কমিউনিটি লাইব্রেরী

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।