কাগজে কলমে মাদ্রাসা সুপার হলেও অলিখিতভাবে তিনি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। বাবার প্রতিষ্ঠিত এমপিওভুক্ত মাদ্রাসায় তিনি এই পদ আগলে রেখেছেন বিগত ১৮ বছর। চাকরির শুরু থেকেই সরকারিকরণের মাধ্যেমে তার বেতনভাতা শুরু। অথচ জীবনে কোনদিন কোন ক্লাশ করাননি তিনি। কোন শিক্ষার্থী তাকে চিনেন ও না। বসবাস করেন রাজধানীতে। চাকরির সমস্ত শর্তভঙ্গ করে জড়িত হয়েছেন রাজনীতিতে। অথচ নিয়মিত উঠছে তার সরকারি বেতনভাতা।

হাজিরা খাতায়ও রয়েছে উপস্থিতি স্বাক্ষর। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন পৌরসভার রানীপুরা এলাকায় অবস্থিত হাজী আবু তাহের ভূইয়া মহিলা সিনিয়র মাদ্রাসা’র সুপারিনটেনডেন্ট এর বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে এই অভিযোগ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রানীপুরা এলাকার আবু তাহের ভূইয়া মহিলা সিনিয়র মাদ্রাসাটি ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আলিম, দাখিল ও এবতেদায়ীয়া তিনটি আলাদা শাখা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাটির দাখিল ও এবতেদায়ীয়া শাখা দুটি সম্পূর্ণ এমপিওভুক্ত। অত্র শাখার শিক্ষকগণ শতভাগ সরকারি বেতনভাতাসহ প্রতিষ্ঠানটি সরকারি সকল সুবিধা পেয়ে থাকে। বর্তমানে এমপিওভুক্ত দাখিল শাখায় ৩০৩ জন ও এবতেদায়ীয়া শাখায় ১৪৫জন শিক্ষার্থী ও ১৬ জন থাকলেও বেসরকারি আলিম শাখায় শিক্ষার্থী রয়েছেন মাত্র ১৪ জন। এই ১৪ শিক্ষার্থীও শিক্ষক আছেন ৬ জন।

পুরো প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল পদে রয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)র কেন্দ্রীয় মহাসচিব বিএম নাজমুল হক ভূইয়া। যিনি রাজধানীর বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা। সেখানকার একটি হাসপাতালে মালিকানা রয়েছে তার।

বিএম নাজমুল হক ভূইয়ার পিতা মরহুম আবু তাহের ভূইয়া অত্র মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। মাদ্রাসার জন্য ৩ একর জমিদানের পাশাপাশি মাদ্রাসা নির্মাণে অবদান রয়েছে তার। ৮৭ সালে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হলেও ১৯৮৪ সালেই নির্মাণের ৩ বছর আগে এমপিও ভুক্ত হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। সে কারণে শিক্ষকের কোন কমতি ছিলো না। ২০০০ সাল অবধি মাত্র ১৩ বছরে ৫ জন সুপারিনটেনডেন্ট পরিবর্তন হয় বিভিন্ন অভিযোগ আর সমস্যা দেখিয়ে। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল করা হন বিএম নাজমুল হক ভূইয়াকে।

কিন্তু যথাযথ যোগ্যতা না থাকায় ওই পদটি শূন্য থাকে। তিনি সহকারী শিক্ষক হিসেবেই ২০০১ সাল থেকে আজ অবধি সরকারি বেতনভাতা পাচ্ছেন। তবে এই বেতনভাতা পাবার বিনিময়ে কোনদিন তাকে শিক্ষকতা করতে হয়নি। নিতে হয়নি শিক্ষার্থীদের ক্লাস কিংবা মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট কোন কাজে কোথাও যেতে হয়নি এই অধ্যক্ষকে। তার পরিবর্তে তার সকল দায়দায়িত্ব পালন করেন তারই চাচাতো ভাই এবং অত্র মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আনোয়ার হোসেন ভূইয়া। অভিযোগ আছে হাজিরা খাতাসহ নাজমুল হকের প্রয়োজনীয় স্বাক্ষরগুলোও তিনিই করে থাকেন। প্রতিষ্ঠানের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী হাবিবা, জাকিয়া, আনিকা আক্তারসহ আরো কয়েজনকে তাদের সুপারিনটেনডেন্ট হুজুরের নাম জিজ্ঞেস করলেও তারা কেউ বলতে পারেননি।

এমনকি তারা কখনো তাকে দেখেননি বলেও জানান। অথচ দীর্ঘ ৬ বছর যাবত তারা এ প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন। অন্য শ্রেণীকক্ষের শিক্ষার্থীদের একই দশা। এসব ব্যাপারে শিক্ষক আনোয়ার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নাজমুল হকের স্বাক্ষর দেয়ার ব্যাপারটা সত্য নয় বলে দাবি করে জানান, অন্য যারা এই পদে ছিলেন তারা বিভিন্ন সময় অনিয়ম আর দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাই প্রতিষ্ঠাতারা প্রতিষ্ঠানটি বাচাতে এগিয়ে আসেন। তিনি এই পদে থাকায় আজো প্রতিষ্ঠানটি টিকে আছে। তাছাড়া তিনি সরকারি বেতনের একটি টাকাও কোনদিন গ্রহণ করেননি। প্রতিমাসের বেতনের টাকাসহ আরো কিছু ভর্তুকি দেন তিনি। যা দিয়ে আলিম শাখার শিক্ষকদের বেতন দেয়া হয়।

এ ব্যাপারে সুপারিনটেনডেন্ট বিএম নাজমুল হক ভূইয়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, একেবারেই প্রতিষ্ঠানে যাই না এ ব্যাপারটা সঠিক না। আগে আমি গ্রামেই ছিলাম। তখন নিয়মিত মাদ্রাসায় যেতাম। এখন ঢাকায় বসবাস করছি বলে কম যাওয়া হয়। আর প্রিন্সিপাল হিসেবে মাদ্রাসা থেকে আজ অবধি কোন সুযোগ সুবিধা আমি গ্রহন করিনি। উপরন্তু চেষ্টা করি প্রতিমাসে মাদ্রাসায় কিছু সহযোগিতা করতে। পিতার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি বাঁচানোর চেষ্টা করছি আমি। তাছাড়া বিজেপির পদ থেকেও সরে এসেছি আমি। এখন আপনারা যদি মনে করেন এ পদে থাকার আমি যোগ্য নই। তাহলে আমি এখনই পদত্যাগ করে চলে আসবো। আপনারাই আমাকে পরামর্শ দেন আমার কি করা উচিত।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি এ উপজেলা সবেমাত্র এসেছি। মাদ্রাসা সুপারের বিষয়টা আমি জানি না। মাদ্রাসায় না এসে রাজনীতি করছে। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম বলেন, মাদ্রাসায় না এসে সরকারে কোষাগার থেকে বছরের পর বছর বেতন তুলে নিবে সেটা মানবো না। আমি দু-একদিনের মধ্যে তদন্ত করে ঘটনাস্থলে গিয়ে যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয় তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিবো।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।