সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়। যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জিত শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জাতিকে উন্নতির সর্বস্তরে নিয়ে যায়। তবে শিক্ষার্থীই হলো শিক্ষার প্রধান উপাদান। একুশ শতকের শিক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কমিশন রিপোর্ট (১৯৯৭) বা ‘ডেলর কমিশন’ শিক্ষার যে চারটি স্তম্ভ নির্ধারণ করেছিল সেগুলো হলো—জানতে শেখা, করতে শেখা, মিলেমিশে বসবাস করতে শেখা ও বিকশিত হওয়ার জন্য শেখা। বর্তমানে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যর সঙ্গে অধিকভাবে যুক্ত হয়েছে গ্লোবাল এডুকেশন বা বৈশ্বিক বাস্তবতা।

শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শিক্ষার মতো শিক্ষাক্রমও একটি পরিবর্তনশীল প্রপঞ্চ—শিক্ষার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সুনির্দিষ্ট, সুপরিকল্পিত ও পূর্ণাঙ্গ পথনির্দেশ। শিক্ষাক্রমের আলোকে যেমন একটি দেশের শিক্ষার দর্শন প্রতিফলিত হয়, তেমনি শিক্ষানীতির উদ্দেশ্যও বাস্তবায়িত হয়। সেই কারণে রাষ্ট্রের সমসাময়িক চাহিদা, নিজস্ব সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের আলোকে শিক্ষাক্রমের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়। একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষাক্রমে সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য কৌশল-পদ্ধতিরও উল্লেখ থাকে। প্রথাগতভাবে শ্রেণি কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্যগুলো অর্জন করানো হয়। এ ক্ষেত্রে শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষকরা প্রয়োজনীয় শিখন-শেখানোর মধ্য দিয়ে নির্ধারিত শিখনফল অর্জন করানোর চেষ্টা করেন। তবে এটাও ঠিক যে শিক্ষাক্রম শুধু শ্রেণি কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ নয়।

বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষার যেসব লক্ষ্য রয়েছে তার অন্যতম হলো—মানবতার বিকাশ, জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা। পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যমে জাতিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতা অর্জন করানো। শিক্ষার সেই মৌলিক উদ্দেশ্যগুলোকে সামনে রেখেই বাংলাদেশে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাক্রম প্রণীত হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীর অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হলো কি না, তা যাচাই করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি থাকলেও বাস্তবে বাংলাদেশে লিখিত পরীক্ষার মূল্যায়নকেই মূল মূল্যায়ন হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষায় যেভাবে ভালো করবে, সেভাবে নিজেদের তৈরি করতে উদগ্রীব থাকছে। অথচ ভালো ফলাফল শিক্ষার একটি উপাদান মাত্র, শিক্ষা এমনকি শিক্ষাক্রমের মূল লক্ষ্য নয়। আবার প্রশ্ন উঠেছে, প্রচলিত পরীক্ষায় ভালো ফলাফলধারী বা সনদপ্রাপ্তরা দক্ষতা অর্জনসহ প্রায়োগিক জীবনে নৈতিকতা-অনৈতিকতার মধ্যে কোনো সীমারেখা টানতে পারছে কি না, মা-বাবাসহ বড়দের প্রতি, দেশের প্রতি সম্মান-ভালোবাসা প্রদর্শন করতে পারছে কি না, সমাজের সদস্যদের সুখ-দুঃখ তাদের স্পর্শ করছে কি না, উপরন্তু কর্মজীবনে অর্জিত জ্ঞান যথাযথ প্রয়োগ করতে পারছে কি না।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষাবিদরাও বলে আসছেন, পরীক্ষা পদ্ধতি শিশুদের মধ্যে অতিরিক্ত লেখাপড়ার চাপ ও ভীতি তৈরি করছে। অর্থনৈতিক বিকাশ, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিশ্বায়নের প্রভাবসহ বিভিন্ন কারণে বাঙালির চিরাচরিত যৌথ পরিবারও দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। বাস্তবে পরিবারের সদস্যরা শিশুদের তেমন সময় দিতে পারছে না। ফলে উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও অপত্য লালন প্রতিষ্ঠান বা বিদ্যালয় হয়ে উঠেছে শিশুর শিক্ষা-মূল্যবোধ গঠনসহ সময় যাপনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। উপরন্তু মিডিয়া বা নেটওয়ার্কের প্রভাবে শিশুর ওপর রয়েছে দেশীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়ের প্রভাব। অভিভাবকরা মানসম্মত শিক্ষা যেমন চায়, তেমনি শিশুর ওপর বইয়ের বোঝাও কমাতে চায়।

একটি জাতি বা রাষ্ট্রের শিক্ষাদর্শ গড়ে ওঠে সেই রাষ্ট্র বা জাতির শাসক বা জনকের নীতি বা আদর্শের ওপর ভিত্তি করে। এ কারণে রাষ্ট্রের পথপ্রদর্শক বা জাতির অগ্রনায়ক যত বেশি গুণাবলির অধিকারী হয়, সেই জাতির শিক্ষাব্যবস্থা তত বেশি উন্নত হয়। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বুদ্ধিজীবী, নারীশিক্ষা ও উন্নয়নের জন্য ইউনেসকো ‘শান্তিবৃক্ষ পুরস্কারে’ ভূষিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৩ মার্চ এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়েছেন, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা পদ্ধতি থাকবে না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তিনি কোমলমতি শিশুদের জন্য ভীতিকর কিছু না করে আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষাদানের কথা বলেছেন। তারও আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘শিক্ষাকে আমি খরচ মনে করি না; আমি মনে করি এটি একটি বিনিয়োগ, জাতিকে গড়ে তোলার বিনিয়োগ।’ অবশ্য ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে দেশবাসীর উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।’ ঐতিহাসিক সমুদ্র জয়ের কারিগর ও বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি মহোদয়ও শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার-পরিমার্জনের কথা বলেছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণা এবং শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্যোগকে অভিভাবকসহ অনেক শিক্ষাবিদ সাধুবাদ জানিয়েছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন থাকছে, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর পরীক্ষাহীন মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নিয়ে। এ কথাও ঠিক যে উন্নত বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্রেই প্রাথমিক শিক্ষার কোনো স্তরেই পরীক্ষাব্যবস্থা নেই। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা যত দিন পর্যন্ত না গ্রেড ৪-এ (১০ বছর বয়স পর্যন্ত) পৌঁছায়, তত দিন তাদের কোনো পরীক্ষা দিতে হয় না। তাদের শুধু শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং নীতি-নৈতিকতা, সহনশীলতা, শিষ্টতা, দেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

৫ থেকে ২ বিয়োগ করলে ৩ হয়। পরীক্ষার খাতায় যে শিক্ষার্থী সেটি লিখতে পারে, বিদ্যমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে তাকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অথচ শিক্ষার মূল বিবেচ্য হলো যে শিক্ষার্থী পাঁচ টাকার কয়েন দিয়ে দুই টাকার চকোলেট কিনে তিন টাকা বুঝে আনতে পারার দক্ষতা অর্জন করেছে কি না তা নিশ্চিত করা। প্রচলিত খাতা-কলমনির্ভর পরীক্ষা পদ্ধতি সব সময় সেই দক্ষতা নিশ্চিত করতে পারে না। সে কারণে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণিসহ অন্যান্য শ্রেণিতেও শিক্ষার্থীর মূল্যায়নের জন্য শিক্ষাক্রমের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংশোধনসহ যথাযথ মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন। শিক্ষার মানোন্নয়নের পাশাপাশি বর্তমান শিক্ষার্থীকে সঠিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, দেশপ্রেম, শ্রদ্ধাশীল, উন্নত চরিত্র গঠন, ভালো আচরণ, উদার, সহনশীল এবং জীবন দক্ষতায় গড়ে তুলতে পারলেই কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ হবে তারা। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞচিত্তে গর্বিত হবে বাঙালি জাতি।

লেখক : শিক্ষা ও জেন্ডার উন্নয়ন গবেষক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।