সরকারি মেডিকেল কলেজের টাকা দিয়ে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কিনতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়েছেন। এর পরই স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের আওতাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন (এমইঅ্যান্ডএইচ এমডি) অপারেশনাল প্ল্যানের ৬৩ কোটি টাকা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই টাকা দিয়ে নতুন পাঁচটিসহ দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের শল্য চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও চিকিৎসা শিক্ষা যন্ত্রপাতি কেনার কথা ছিল। কিন্তু মেডিকেল কলেজের খাতে ব্যয় না করে ওই টাকা দিয়ে সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ও কিডনি ডায়ালাইসিস যন্ত্রপাতি কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তড়িঘড়ি করে ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে গিয়ে কোন হাসপাতালের কয়টি যন্ত্র লাগবে কিংবা আইসিইউ ও কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন চালানোর মতো প্রশিক্ষিত জনবল সেসব হাসপাতালে আছে কি-না তা আমলে নেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোন কোন হাসপাতালে এসব যন্ত্রপাতি যাবে, সে সম্পর্কেও কাগজপত্রে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি কোনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও এ-সংক্রান্ত কোনো চাহিদাপত্র পাঠায়নি। এর পরও অর্থবছরের শেষ সময়ে যন্ত্রপাতি কিনে তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, `যখন একটা রিকয়ারমেন্ট তৈরি করা হয়, তখন সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করা দরকার। খেয়াল করতে হবে, নতুন সরকার এসেছে। নতুন মন্ত্রী এসেছেন। এমনকি ডিরেক্টর, লাইন ডিরেক্টরও পরিবর্তন হয়েছে। একটি রিকয়ারমেন্ট মেডিকেল কলেজগুলোর কাছ থেকে যাচাই করেছিলাম, তাতে মনে হয়েছে, এ ধরনের প্রয়োজন তাদের সবার নেই। কারণ আগেই বেশকিছু কেনা হয়েছিল। তাই ওই কোডের বরাদ্দ দিয়ে হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সরকারি মেডিকেল কলেজের কয়েকজন অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের ৪২টি সরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের প্যাথলজি, এনাটমি, ফিজিওলজি, ফার্মাকোলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফরেনসিক মেডিসিনসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক কাজে যন্ত্রপাতির প্রয়োজন। মেডিকেল শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য এসব যন্ত্রপাতি অপরিহার্য।

ঢাকার বাইরের একটি মেডিকেল কলেজের একজন অধ্যক্ষ জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রায় ছয় মাস আগে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষদের কাছে যন্ত্রপাতির চাহিদা চেয়েছিলেন। অধ্যক্ষরা চাহিদাপত্রও পাঠিয়েছিলেন। তাদের জানানো হয়, আলোচনা করে যন্ত্রপাতি ক্রয় প্রক্রিয়ায় যাওয়ার জন্য তাদের অনুমতি দেওয়া হবে। এরপর জানুয়ারিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তাদের ডেকে জানানো হয়, কেন্দ্রীয়ভাবে যন্ত্রপাতি কিনে দেওয়া হবে। এখন শোনা যাচ্ছে মেডিকেল কলেজের টাকা দিয়ে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন অধ্যক্ষ জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একশ্রেণির কর্মকর্তা ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে গত বছরের শেষ দিকে মেডিকেল কলেজ কোডের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাসপাতালের কোডে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেন। নির্বাচন শেষে নতুন সরকার গঠনের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ওই চক্রটি সফল হয়। দুদকের ভয় দেখিয়ে ওই কর্মকর্তা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষদের কেনাকাটা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। এ কারণে প্রয়োজন থাকার পরও অধ্যক্ষরা অনেকে চাহিদাপত্র পাঠাননি। এতে করে ওই চক্রটি অর্থ অব্যয়িত দেখানোর সুযোগ পায়। এর পরই ওই সিন্ডিকেটের মূল হোতা ওপি পর্যালোচনার টাকা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে স্থানান্তরের প্রস্তাব করেন। ওই সভায় একজন উপসচিব ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। এর আগেও যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় বিভিন্ন সময়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এই যন্ত্রপাতি কেনাকাটা সম্পন্ন হলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমিশনের টাকা ওই সিন্ডিকেটের পকেটে যাবে। এ কারণে তারা এসব যন্ত্রপাতি ক্রয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়শনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, যন্ত্রপাতি কেনাকাটা করতে পারলেই তো টাকা-পয়সা কমিশন পাওয়া যায়। এই প্রক্রিয়াও সেটির অংশ।

বিএমএ মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, মেডিকেল কলেজের টাকা দিয়ে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থবছরের শেষভাগে এসে কোড পরিবর্তন করে এ ধরনের কেনাকাটার উদ্দেশ্য ভালো নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। চলতি অর্থবছরে যে সময় আছে, এর মধ্যে কোন প্রক্রিয়ায় এসব যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ ওপি সংশোধনের আগে তারা টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যেতে পারবে না। সেটি তো সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ওপি সংশোধনের আগে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় গেলে মনে করতে হবে পরস্পরের যোগসাজশে এসব ঘটনা ঘটছে।

স্বাচিপ সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান বলেন, দেশে এমনকি জরুরি অবস্থা হয়েছে, যে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ বাদ দিয়ে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কিনতে হবে? মানসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরি না করে যন্ত্রপাতি কিনে হাসপাতালে ফেলে রাখলেই কি চিকিৎসা নিশ্চিত হবে? এসব যন্ত্রপাতি যারা অপারেট করবে সেই দক্ষ জনবল তো আগে তৈরি করতে হবে। এসব কর্মকাণ্ড কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের ফলাফল শুভ হবে না বলে মনে করেন তিনি।

মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষদের বক্তব্য : চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. জামাল সালেহ উদ্দিন বলেন, চাঁদপুর মেডিকেল কলেজে লাইব্রেরি, মেডিকেল শিক্ষার বই, শিক্ষা উপকরণ থেকে শুরু করে কিছুই নেই। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ অবহিত। আমরা তাদের কাছে চাহিদাপত্রও পাঠিয়েছি। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি।

নেত্রকোনো মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. একেএম সাদেকুল আজম বলেন, নতুন মেডিকেল কলেজ হিসেবে তার প্রতিষ্ঠানে এখনও কিছুই নেই।

নওগাঁ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল বারী বলেন, নতুন মেডিকেল কলেজ হিসেবে তাদের কেন্দ্রীয়ভাবে কেনাকাটা করে শিক্ষা উপকরণগুলো দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি যেভাবে : কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের আওতাধীন চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শীর্ষক অপারেশনাল প্ল্যানের চলতি অর্থবছরের অব্যয়িত অর্থের বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে গত ২০ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মাকসুদা হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ (বিএসএমএমইউ) দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আইসিইউ ও ডায়ালাইসিস যন্ত্রপাতির সংকটের কারণে রোগীদের চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। এ সংকট মোকাবেলার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন (এমইঅ্যান্ডএইচএমডি) অপারেশনাল প্ল্যানের আওতায় আইসিইউ ও ডায়ালাইসিস যন্ত্রপাতি ক্রয়ের নির্দেশনা প্রদান করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সম্মতিক্রমে এমইঅ্যান্ডএইচএমডির লাইন ডিরেক্টর ওপির বিপরীতে বরাদ্দকৃত কোডভিত্তিক বাজেটের অর্থ দিয়ে বিএসএমএমইউসহ দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আইসিইউ ও ডায়ালাইসিস মেশিন সরবরাহ করার প্রস্তাব করেছেন। এ প্রস্তাব স্বাস্থ্যমন্ত্রী অনুমোদন করেছেন এবং এ বিষয়টি ওপি সংশোধনের সময় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ অবস্থায় ওপির শল্য চিকিৎসা সরবরাহ কোড নম্বর ৩২৫২১০৫ এবং চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৪১১২৩১৫ কোড নম্বরের ৬৩ কোটি টাকা স্থানান্তরে অনুরোধ করা হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৯ মে অর্থ মন্ত্রণালয় এই অর্থ ব্যয়ের সম্মতি দেয়। তবে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে পাঁচটি শর্তারোপ করা হয়। এরপর সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হয়।

ওপি পর্যালোচনা সভায় যে যা বললেন : চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন ওপির অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য গত ২৩ এপ্রিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন ওপির অর্থ স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ওপিতে স্থানান্তরের প্রস্তাব দেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন সভায় উপস্থিত উপসচিব (পরিকল্পনা) আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের ফাইন্যান্সিং মডেলিটি অনুযায়ী এক বিভাগের ওপি থেকে অন্য বিভাগের ওপিতে অর্থ স্থানান্তরের সুযোগ নেই। পরিকল্পনা কমিশন এটি করতে পারে যা সময় সাপেক্ষ।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ওই সভায় সবার সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত চাহিদা নিরূপণের তাগিদ দেন। একইসঙ্গে ওই চাহিদার তালিকা ধরে পিপিআর অনুসরণ করে স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দ্রুত যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, চিকিৎসাসামগ্রী, বইপত্র সরবরাহ করার নির্দেশ দেন। জন্যে: সমকাল

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।