গল্প: অসমাপ্ত
পশ্চিমের বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি।শেষ বিকেলের ঘুমন্ত রোদ লুকোচুরি খেলছে তার মলিন মুখে। কী গভীর বেদনায় সে নিঃশেষ হচ্ছে তিলে তিলে। কী অব্যাক্ত কষ্ট কুঁড়ে কুঁড়ে ধ্বংস করছে অবিরত তার হদিস করতে পারেনা ফরাজি।অফিস থেকে ফেরার পথে খুব গোপনে চুপ চুপ করে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটু দেখার পিপাসা তার মেটেনা। তৃষ্ণা নিয়ে ঘরে ফেরে ফরাজি।ঘর তার শূন্য। প্রেয়সী আজও আসেনি।কলেজে পড়তে যে মেয়েটিকে ভালোবেসেছিল তাকেও কখনো সাহস করে বলা হয়নি। তারপর থেকে সেসব চিন্তা ফরাজি ছেড়েই দিয়েছিল। এখন সরকারি জব করছে। পাঁচ মাস হল। বাড়িতে বাবা নেই। হঠাৎ করেই অসুখে চলে গেলেন বছর দু’য়েক আগে।মাথার ছাদ উড়ে যেন এক বিশাল শূন্যতা। ছোট ভাই ঢাকা ভার্সিটিতে প্রথম বর্ষের ছাত্র।

মা ভাইকে নিয়ে সুখের সংসারে এখন সে বড় একাকী অনুভব করছে।রাতে ঘুম আসেনা। সারাদিন সেই মলিন মুখটা ফিরে ফিরে আসে।কোনো ছুঁতোয় যদি দেখা হত! ভাবতে ভাবতে ঘুম যখন তার ঘরে নিয়ে যায় সে খুঁজে পায় এক মুক্ত দিগন্ত।সবুজ আর সবুজ।আকাশটা গাঢ় নীল।যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু নীল সবুজের মাখামখি।হঠাৎ তার কাঁধে হাত।ঘুরে দেখে সেই মলিনা। মনে মনে যাকে সে মলিনা বলেই ডাকে।সহস্র কথা হারিয়ে যায় কিছুক্ষণ। তার দিকে নিস্পলক চেয়ে থাকে। মলিনা খুব হাসছে। তার হাসির শব্দ শূন্যতায় সুরের ঝংকার তুলছে।

ফরাজি বুঝে উঠতে পারছেনা কি বলবে। সাহস করে দুই বাহু ধরে বলল, মলিনা, আমার মলিনা। থাম প্লিজ।এভাবে হাসছ যে? আমি তোমার অপেক্ষায় অধীর হয়ে আছি। মলিনার হাসি মৃদু হয়ে এলো। আস্তে করে বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে চলল। আমি নিষ্পলক চেয়ে আছি। অনেকটা পথ সে চলে গেলো। যেন শুন্যতায় মিলিয়ে যাচ্ছে মেঘের মত।

আমি হাত বাড়িয়ে ডাকছি- থাম, একটু থাম মলিনা। মলিনা! মলিনা!
কিরে, কি বলছিস বিরবির করে? এই ফরাজি, বাবা। মা গায়ে হাত দিতেই ফরাজি ধড়ফড় করে উঠে বসল। মাকে দেখে বুঝতে পেল সে এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিল। না, কিছু না মা। মায়ের হাত ধরে বলল ফরাজি। মুচকি হেসে মা বলল, বাবা, একটা কথা বলি। কাল ঘটক এসেছিল। কয়েকটা মেয়ের ছবি দিয়ে গেছে। আমার একজনকে খুব পছন্দ হয়েছে।  তোর টেবিলে মেয়েটির ছবি আছে। দেখে নিস। আর তোর যদি অন্য কাউকে ভালো লেগে থাকে তো বলিস আমাকে। আচ্ছা, এখন ফ্রেশ হয়ে নে। আমি নাস্তা করছি।এই বলে তিনি চলে গেলেন। সুবোধ বালকের মত মাথা নেড়ে নিরব সম্মতি জানালো ফরাজি।
বালিশটা কোলে নিয়ে ভাবছে- বাস্তবতা অনেক কঠিন। রবি ঠাকুর লিখেছেন-

“সত্য যে কঠিন।কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।” কঠিনের সাথে চলতে সে জানে।আজ সব জানাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে, ছবিটা যদি মলিনার হতো!  তবে মায়ের কাছে দৌঁড়ে  গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলত-আমি রাজি মা। আমি রাজি। নিজের পাগলামি চিন্তায় নিজেই হাসল একটু হতাশার হাসি।মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে উঠে পড়ল। তৈরি হয়ে নিল অফিসের জন্য।
উত্তর কাফরুলে থাকে সে। সেখান থেকে অফিস ধানমন্ডি ১০। কি যে ঝক্কিঝামেলা। আর ঢাকার জ্যাম এই শব্দটা বহুল জনপ্রিয়। আলোড়িত শব্দ।দূর, এসব নিয়ে ভেবে নিজের মাথার জ্যাম বাঁধিয়ে লাভ নাই। আজ কি করে যে মলিনাকে বলব। সাহস যেন থাকে মনে। টেনশনে কপালে, নাকে জমছে ঘাম। মনে মনে খুশি হচ্ছে এই ভেবে- বৌ তাকে অনেক ভালোবাসবে। ছোট থেকে তার নাক ঘামা দেখে অনেকের মুখেই শোনা। মুচকি হাসছে এমন সময় সজোরে ব্রেক। সামনে একটু হোচট খায় সে। কি মামা, দেখে চালাও। তোমারা আজকাল কি যে কর। কি যে অবস্থা আজকাল।  কথা  শেষ হতেই গন্তব্য স্থান চলে আসে। ফরাজি বলে,সামনে বামে রাখ মামা।
অফিসে আজ সে উদাসিন। কোনো কাজে মন বসছে না। সবার চোখে পড়ল রীতিমত। নিজেকে ব্যাস্ততার ভাব দেখিয়ে কেটে পড়ল সবার কাছ থেকে। বাইরের কাজ নিয়ে আগেই বেরিয়ে পড়ল অফিস থেকে।কোথাও আজ স্থির হতে পারছেনা। বারবার ঘড়ি দেখে আর বলে, বেটা ঘড়ি আজ কেন ঘুরিস না। যদি নিজের হাতে থাকত এমন কোনো ক্ষমতা তবে কাঁটা ঘুড়িয়ে দুপুর কে করে দিতাম বিকেল।

এমন নানা ভাবনার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে প্রতিক্ষার  দ্বার  প্রান্তে মুখোমুখি  সংঘর্ষ  বাঁধতে গিয়ে বাঁধল না। চোখে চোখ পড়তে ফরজির চোখ রসগোল্লা। মিম এর রক্তচক্ষু দেখে ফরাজি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মিম পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই ফরাজি ডেকে উঠল, “প্লিজ ম্যাম, প্লিজ।

মিম ঘুরে দাঁড়াল। একটু বিরক্ত হয়ে  বলল, আমাকে বলছেন? দেখেই মিম চিনে ফেলল তাকে।  এই ছেলেটির ছবি তো ঘটক তার মা কে দিয়েছিল। আর প্রশংসায় আটখানা। ফরাজি বেশ স্মার্টলি বলল,  ম্যাম অনুমতি দিলে কিছু কথা বলার ছিল। মিম সে সুযোগ আর দিলনা। রাগান্বিত সুরে বলল,কোনো লাভ নেই। কি বলবেন বোঝা শেষ। আমি আপনাকে বিয়ে করব না। বুঝলেন?এই বলে  গটগট করে চলে গেলো। কেউ যেন এক ধাক্কা দিয়ে ফরাজি কে পানিতে ফেলে দিল। নাকানি চুবানি খেয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে বুঝল সে পৃথিবীর স্থল ভাগেই আছে।  জলে না। তাই হেঁটে বাড়ির পথে রওনা হল। এত কিছুর পরও এই ভেবে তার ভালো লাগছে যে,টেবিলে রাখা ছবিটা নিশ্চই মলিনার। পথ তার আজ যেন ফুরোয় না।কখন ফিরবে আর ছবি নিয়ে মাকে বলবে সে ভাবনায় ব্যাকুল। রুমে গিয়ে সোজা টেবিলের কাছে দুরুদুরু বুকে হাতে তুলে নিল ছবিটা।  বেশ মিষ্টি মুখ। মায়াবী।  খুব সাধারন।  কিন্তু তার মলিনা অসাধারন।  আর মলিনার সাথে সে কাউকে তুলনা করতে পারেনা। সে মলিনাকেই চায়। ফরাজি তার মায়ের রুমে দ্রুত গিয়ে মা,মা বলে ডেকে হয়রান। মা ছেলেকে অস্থির দেখে জানতে চাইল, কি হয়েছে?  এমন লাগছে যে? মা,কিছু না।  তুমি আমাকে একটু ছবি দুটি দাও তো। কোন ছবি?ও বুঝেছি।

থাম। এই বলে ড্রয়ার থেকে একটি খাম বের করে হাতে দিয়ে বলল, নে। দেখে জানাবি বাবা।
থ্যাংক ইউ মা, বলে তার রুমে ফিরল ফরাজি। তাড়াতাড়ি করে খাম থেকে বের করে দেখে মলিনার মলিন মুখের ছবি। কি মায়াবী! কী এক গভীর বেদনা তার জীবনের হাসি কেড়ে নিয়েছে কে জানে!
ফরাজি তার মাকে জানালো এই  মেয়েকে তার পচ্ছন্দ। মা বলল, আচ্ছা বাবা,ভাবিস না। আমি কাল বিকেলে ওদের বাসায় যাব।  তুই এখন ফ্রেশ হয়ে নে। চা দিচ্ছি। টেবিলে আয়। ওকে ডিয়ার মাম। আমি আসছি,এই বলে ফরাজি নিজ রুমে চলে গেল। আজ রাত তার কেটে গেল ছবির সাথে কথা বলতে বলতে।মলিনা, তুমি শুধু আমার। আমার লাল টুকটুক বউ তুমি। লাল বেনারসি পড়াব তোমাকে। লাল গোলাপে সাজাব ঘর। তোমার হাত ধরে গল্প করব সারারাত। তোমার মুখের হাসি ফিরিয়ে আনব আমি। তোমার সব অপূর্ণতা পূরণ করব ভালোবাসা দিয়ে। তোমার চোখের জল মুছে আমার বুকে দিব শান্তির স্বর্গ। অবশেষে কোন ভাবনা ঘুমের দেশে নিয়ে গেল জানেনা ফরাজি।

যথারীতি ফরাজির মা বিকেল হতে চলে গেলেন। টুং টাং শদ পেয়ে দরজা খুলে দিল বাড়ির বুয়া। জানতে চাইল কাকে চান? তিনি বললেন,মিম এর মা আছেন? আমি ওনার সাথে কথা বলতে এসেছি।
বুয়া বলল,জি, আছে। আপনি বসেন। আমি ডাকতাছি। কিছুক্ষণ পর একজন ভদ্র মহিলা আসলেন। তার চোখ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে তিনি কাঁদছিলেন।

সালাম দিলেন।  উত্তর জানিয়ে বসতে বললেন মিমের মা। তার এ অবস্থা দেখে বিব্রত বোধ করছিলেন। কি বলবেন, কিভাবে বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। পরিবেশ টা ভালো মনে হচ্ছিল না ফরাজির মায়ের কাছে। মিমের মা বললেন,আপা, কী বলববেন যেন?

আপা,মিমের বিষয়ে এসেছি। কয়েক দিন আগে ঘটক এসেছিল। তার কাছে ঠিকানা পেয়ে আসা। ভদ্র মহিলা আবার আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। বললেন,আপা, কিভাবে যে বলি! আপনি সহজ করেই বলেন।বুঝতে পারছি কোনো সমস্যায় আছেন। তিনি বলতে শুরু করলেন, আপা,বছর খানেক আগের কথা।
আমি রান্না করছিলাম।ঘরে ঢুকেই মিম পিছন থেকে গলা জড়িয়ে বলল,আম্মু,আম্মু আই লাভ ইউ।
হাসি মুখে  বললাম, কি বলবি বলতো?

আব্বু কে বলবে না। বুঝেছি তবে কি বায়না। আরে না মামনি, বোঝনি। খুব ভয়ংকর ব্যাপার। এ কথা শুনে মিমের মা একটু গম্ভীর হলেন। বুকটা তার একটু কেঁপে উঠল। একটাই মেয়ে তার। নানা ভয় সারাক্ষন উঁকি দেয় মনের মাঝে। বেশ বুঝতে পারছেন মেয়ে এখন কি বলতে চাইছে। মায়ের মন। ইশারায় বুঝে যায় সব কিছু। ভাবেন, সে তার মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছে নিশ্চই।  ওর স্বপ্ন কে পূরণ করব। নিজের জীবন তো গেল জ্যান্ত লাশের মত। মেয়ের হাত ধরে বেড রুমে নিয়ে গিয়ে বসালেন পাশে। বললেন,এবার বল,কে সে?নাম কী?কোথায় থাকে?কী করে? ওরে বাবা,তুমি দেখি উকিলের মত জেরা করছ। মা হেসে বলল, সব যে একবারেই শুনতে ইচ্ছে করছে।

ওকে,বলছি। ফাহিম।আমার বন্ধু।থাকে কল্যানপুর। বাবা ব্যবসায়ী।মা গৃহিণী। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। দুলাভাই পুলিশের ওসি। নাটোর থাকে। তার এক ছেলে। একটানা বলে মিম দীর্ঘ  শ্বাস  ফেলে। আচ্ছা, ওকে কাল দুপুরে আসতে বল।তোর বাবা কাজে ঢাকার বাইরে যাবে। আমি কথা বলব। মেয়ের দুই হাত নিজের হাতের ভিতর সযতনে নিয়ে বললেন। মায়ের দুই গালে চুমু দিয়ে দৌঁড়ে  চলে গেল মিম তার রুমে। বিছানায় হেলান দিয়ে ফোন করে ফাহিম কে বলল,জনাব ফাহিম বলছেন? জি, আপনার গোলাম।

তাই বুঝি? তো জনাব কাল দুপুরে আমার আম্মিজান আপনার মুখখানি দর্শন করবেন।  যথাসময়ে আসার জন্য আদেশ করলাম। মিটিমিটি হাসি মুখে বলল মিম।
জি, হুকুমের গোলাম। তবে এই ভীরুর জন্য সুপারিশ করা হবে তো। নইলে ম্যাডাম পরীক্ষায় যে ফেল করব। আহা! তবে তো করতেই হয়। সব হবে জনাব।  আপনি শুধু হাজিরা দিন। ওকে আমি যথাসময়ে আসছি। তো এখন একটু রাখি ম্যাম। অফিস থেকে ফোন আসছে।

হুম। পরে কথা হবে। আজ রাত দুজনার কাটতেই চাইছিল না। মিম তো সারা রাত  এপাশ ওপাশ করে কাটিয়েছে। অবশেষে কোল বালিশ বুকে নিয়ে কখন যে ঘুমিয়েছে জানা নেই তার। আর ফাহিম সারা রাত নেট এ অফিসের কাজের ফাঁকে মিম কে নিয়ে ভবিষ্যৎ এর জল্পনাকল্পনা করেছে। যথারীতি সময় ঘনিয়ে এল। কিচিরমিচির পাখির ডাক শুনে মিম ছুটে এসে দরজা খুলে দিল।

লাল গোলাপ হাতে দিয়ে ফাহিম বলল,শুভ দুপুর ম্যাডাম। ভিতরে আসতে পারি? মিম লজ্জায় গোলাপের মত লাল হয়ে গেল। মাথা নেড়ে, ঠোঁটে কামড় দিয়ে সম্মতি দিল। ফাহিম কে বসতে দিয়ে মাকে ডাকতে চলে গেল। ফাহিম এর বুক দুরুদুরু করছে। পাশে দেখে নজরুলের কবিতার বই। তার প্রিয় কবি। মিম তার আবৃতি শুনে কত দিন হেসেছে কেঁদেছে ঠিক নেই। মনে মনে ফাহিম আবৃতি করে-
“গান ফুরালে যাব যবে গানের কথাই মনে রবে, পাখি তখন থাকবে না ক’-থাকবে পাখির  স্বর, উড়ব আমি,কাঁদবে তুমি ব্যাথার বালুচর।” মিম তার মাকে নিয়ে আসে। ফাহিম তাদের দেখে দঁড়িয়ে যায়। সালাম দিয়ে রজনীগন্ধার তোড়া দিয়ে বলে – মা আপনার জন্য। তিনি হেসে বললেন,বাবা, কি করে জানলে এ ফুল আমার পচ্ছন্দ? মিম বলেছে? জি।
অনেক খুশি হয়েছি বাবা। বেশ দেরি হয়ে গেছে। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। আগে ডাইনিং এ আস। খেয়ে নিয়ে কথা হবে।

জামাই আদর ভালোই পেল ফাহিম।বিরানি,কাবাব,চিকেন ফ্রাই,কোপ্তা,পুডিং,ফালুদা ইত্যাদি খেয়ে ফাহিম এর ওজন যেন পাঁচ কেজি বেড়ে গেল। মায়ের অনুরোধ, মিমের বায়না সব মিলে আজ বেচারা নাজেহাল। সে একটু কম খেতেই পচ্ছন্দ করে তাই আজ বেহাল দশা। সোফায় বসে অনেক কথা হলো তাদের। মিমের চঞ্চলতা, উদাসীনতা, খেয়ালিপনা তার মায়ের খুব ভয়ের কারন। তাছাড়া মিম ভিতরে খুব জেদি। তার মন কখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিলে আর সেখান থেকে ফেরানো কঠিন। কারন এ জেদ সে সচারচর করে তা নয়।

ফাহিম হুম বলে একমত পোষণ করল। আমি আন্টি জেদ করিনা। তবে অভিমান হয়। আর তা ভাঙ্গাতে বেগ পেতে হয়না। আর কি করি শুনতে আম্মুর কাছে যেতে হবে। কবে আসবেন বলুন। তোমার আংকেল এর সাথে কথা বলে জানাব। তুমি ভেবো না। আমি আছি তোমাদের সাথে। মিম ততক্ষণে চা করে নিয়ে আসে। এই যে গরম গরম চা। যে যে খাবে হাত তোলো। সবাই মৃদু হাসে। চা পর্ব শেষে ফাহিম বিদায় নেয়।যাবার সময় মিম কে বলে- “তুমি অমন ক’রে গো বারে বারে
জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না,
জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না।
ঐ কাতর কন্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না, শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না।।”

মৃদু হেসে বলে, ঠিক আছে এসো। ফোনে কথা হবে। দরজা দিয়ে মিম বারান্দায় চলে যায়। যতদূর দেখা যায় চোখের পলক ফেলে না সে। দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে তবু দাঁড়িয়ে আছে। কি এক গোপন ব্যাথা ! এক অশুভ  বাতাস মনকে ভারি করে তুলছে। সুখের অনুভূতি কষ্ট নিচ্ছে তার দখলে। বেশ খানিক পর রুমে এসে শুয়ে পড়ে। তারপর মোবাইল এ কল দেয়। কিন্তু বন্ধ পায়। কয়েকবার দুঃখিত শুনে ছটফট করতে থাকে। মোবাইলে চার্জ তো থাকার কথা। না থাকলে জানাত। নেট তো ঠিক আছে।  তো! এলোমেলো ভাবনায় মিম স্থির থাকতে পারছে না। বারান্দা, ঘর পায়চারী করছে। ভাবছে, বাড়ি এতক্ষণে পৌঁছাবে না। অন্য কোথাও গেলে তো জানাত। তাই বাড়িতে ফোন দিতেও পারছে না। সবাই চিন্তা করবেন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা।  রিং বেজে উঠতে মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ফাহিমের বাবার নাম্বার। তিনি এ খবর দেবার মানসিক প্রস্তুতি নিতে পারছিলেন না। যাকে ঘিরে ফাহিমের আগামী। তার আনন্দ এখানেই থেমে যাবে খসে পড়া তারার মত তা তো জানা ছিল না কারো। মিম অস্থির হয়ে বলছে, হ্যালো, আংকেল।হ্যালো,কথা বলেন। ভালো আছেন তো। ওপাশের নিরবতা মিমের মন কে জানিয়ে দিচ্ছে তার জন্য কোনো অশুভ সংবাদ অপেক্ষা করছে।

তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে জনালেন,ফাহিম নেই। ফাহিম আর ফিরবে না, মা। এক দৈব আওয়াজ যেন জীবন কে এখানে স্থির করে দিল। সেল ফোন দুই হাতে শক্ত করে ধরে আছে।তার কষ্ট গুলো যেন শুষে নিচ্ছে ফোনটি। চোখে জল নেই। যেটুকু থাকে তাও শুকিয়ে গেছে। নিষ্পলক তাকিয়ে সন্ধ্যা আকাশের তারা দেখছে। ওই যে তারা! মিটমিট করে জ্বলছে। ফাহিম তুমি কোন তারা হলে! তুমি তারার দেশে একাই কেন গেলে? আমাকে ছাড়া তুমি না এক মুহূর্ত থাকবে না বলেছ। তুমি না বলেছ দুজনে একসাথে বাঁচব। স্বপ্নের পৃথিবী গড়ব। তবে কি মিথ্যে বলেছিলে? পাথর দেহ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে তার। মেয়েকে এভাবে দেখে আঁৎকে ওঠে মায়ের মন। কাঁধে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলে,কি হয়েছে মা? ফাহিম কিছু বলেছে? মিম মায়ের হাত ধরে বলে, মা,ওই যে তারা দেখতে পাচ্ছ? ফাহিম তারা হয়ে গেছে।

ওই আকাশে থাকে। আমাকে না নিয়ে চলে গেছে। বলো মা এটা মিথ্যে কথা। আমি মানিনা মা। আমি মানি না। ফাহিম আছে। ওই তো ফাহিম। ওই যে হেঁটে গেলো পথ ধরে। আমি নিজে ওকে বিদায় দিলাম। মা, কিছু বল, চুপ থেকো না। মেয়ের এই অবস্থায় মায়ের চোখ গড়িয়ে জল বইছে। নিজের মনকে শক্ত করলেন তিনি। মেয়েকে আগলে ধরে বললেন, আছে। ফাহিম আমাদের মাঝে আছে। তুই চুপ কর। একটু শান্ত হতে চেষ্টা কর। সব ঠিক হয়ে হবে। চোখের জল মুছতে মুছতে মিমের মা বলল,আপা,এই আমার মেয়ের জীবনের ঘটে যাওয়া দুঃসময়। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে তবু সে ভুলতে পারছে না। রোজ বিকেলে ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। ওর কষ্ট আমি মেনে নিতে পারছিনা। ওর বাবা বিয়ে দিতে চাচ্ছে জেনে রাগ করে খালার বাসায় চলে গেছে। কি করব বুঝেতে পারছিনা।
ফরাজির মা তার পাশে গিয়ে হাত দুটো ধরে বললেন,আপা, একদম ভাববেন না।  ঠিক হয়ে যাবে। মন বলে কথা। কেউ এসে ভালোবাসলে ভুলে যাবে। তবে জোড় করতে গেলে সমস্যা বাড়বে। তাই বলছিলাম আর একটু সময় নিন।

আপনি ঠিক বলেছেন।  ওকে আর একটু সময় দিতে হবে। আর বাইরে কোথাও যাব ভাবছি। তাতে ওর মনটা হালকা হবে।

আমার ছেলে মিম কে হয়তো আগেই দেখেছে। ওর খুব পছন্দ। তাই আসা। এখন তাকে গিয়ে কি বলব সে ভাবনায় মনটা অস্থির লাগছে। আচ্ছা, আজ উঠি।

মিমের মা বলল,আপা, মিম এর চিন্তার বাইরে আমি এখন কোনো কথা দিতে পারব না। তবে আপনার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগলো। আপনি আসবেন আবার। বিদায় নিয়ে এই চরম সত্য জানাতে হল ফরাজি কে।   বলল,বাবা, মিমের জন্য ভেবে মন খারাপ করিস না।
মাকে আহত দেখে ফরাজি হেসে বলল,দূর, তুমি যে কি মা। মেয়ের অভাব পড়েছে নাকি। দেখবে আরো সুন্দরী মেয়ে পাব। এই বলে দ্রুত সে রুমে চলে গেল। তার চোখ গড়িয়ে জল পড়তে দিল না। কারন মলিনা তার মানসপটে আঁকা ছবি। মলিনার ছবি নিয়ে বলতে থাকে- হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি। শুধু পটে লেখা?তুমি স্থির, তুমি ছবি তুমি শুধু ছবি।

মলিনাকে সে লালন করে যাবে। পাওয়ার চেয়ে বড় পাওয়া সে। মনের গহীনে সুপ্ত সে। সবার অন্তরালে শুধু এক কল্পনার রাজকুমারী। সেই কল্পনার কল্পনায় আবার হল ভোর।আজ ভোর অন্যরকম আমেজে। সেই আনন্দের হাতছানি নেই।  চলার ছন্দ নেই। সময়ের গতিতে চলছে। যথাসময় ফেরা অফিস থেকে। আজ আর সেই বারান্দায় তাকানোর অজুহাত নেই। একবার তাকিয়ে দেখল কি নিঃসঙ্গ বারান্দা! কেউ ভালোবেসে জড়িয়ে নেই। মানিপ্লান্টের গাছটি কারো অবহেলায় নুইয়ে পড়ে আছে। কারো অপেক্ষায় রোদেরা দিশেহারা।  আর আমি- বলি,”তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।