ঋণখেলাপিদের নানা সুবিধা ঘোষণার মধ্যেই ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ বেড়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে নতুন করে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। জুন শেষে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আর অবলোপনসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে বিতরণ করা হ‌চ্ছে ঋণ। আদায় হচ্ছে না। এসমস্ত কারণেই বিপাকে পড়েছে ব্যাংকগুলো। নানা উদ্যোগেও খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

খেলাপি ঋণের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা জুন’১৯ প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। প্র‌তিবেদনের তথ্য বল‌ছে, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন এই তিন মাসে নতুন করে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।

জুন শেষে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। আর অবলোপনসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আ‌গের বছরের জুন পর্যন্ত অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ ছিল ৯০ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। এ হিসা‌বে গত এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। আগের প্রান্তিক জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।

এই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়লেও সরকারি ও বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে। এতে শতকরা হিসাবে সার্বিক ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার কমেছে। গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা জুনে হয়েছে ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রতি বছর জুন ও ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমে যায়। শতকরা হারের পাশাপাশি পরিমাণগত হিসাবেও কমে খেলাপি ঋণ। কিন্তু এবার জুন প্রান্তিকে শতকরা হিসাবে খেলাপি ঋণ কমলেও পরিমাণগত হিসাবে বেড়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এর মানে খেলাপি ঋণের কোনো উন্নতি হয়নি। কারণ খেলাপি ঋণ আদায় করার ব্যাপারে যে সর্বাত্মক চেষ্টা করা উচিত, সেটা আসলে হচ্ছে না। উল্টো ঋণখেলাপিদের ছাড় দিতে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। ঋণ অবলোপনের সময়সীমা পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে তিন বছর করা হয়েছে। ঋণ শ্রেণিকরণের সময়সীমায়ও ছাড় দেয়া হয়েছে। এছড়া বিশেষ পুনঃতফসিল নীতিমালা করা হয়েছে। এসব সুবিধা দেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, এত কারচুপি করার পরও খেলাপি কমেনি। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনান হয়েছে। পুনঃতফসিলের নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। এর মাধ্যমে খেলাপিদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। তবুও খেলাপি ঋণ যখন কমেনি, এতে বুঝা যায় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণ কমানো যাবে না। বরং এই ধরনের সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে খেলাপিরা আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।

গত ৪ আগস্ট বেসরকারি ৪০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমে আসবে। কিন্তু জুন প্রান্তিকে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও হার দুই বেড়েছে। গত মার্চ শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৯ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ।

প্র‌তি‌বেদ‌নের তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে এ খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। এ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা বা ৩১ দশমিক ৫৮ শতাংশ, গত মার্চ শেষে যা ছিল ৫৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা বা ৩২ দশমিক ২০ শতাংশ। গত মার্চ পর্যন্ত বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২৫৬ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। জুন শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমে হয়েছে দুই হাজার ৫৭ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এ সময়ে বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। আগের প্রান্তিকে তাদের খেলাপি ঋণ ছিল চার হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা।

বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের পরই আ হ ম মুস্তফা কামাল নতুন করে খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না বলে ঘোষণা দেন। এ জন্য তিনি ঋণখেলাপিদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা ও ছাড়ের পথ তৈরি করেন। তারপরও জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বাড়ে খেলাপি ঋণ। গত মার্চ শেষে প্রথমবার অবলোপন বাদে খেলাপিঋণ এক লাখ কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে আট লাখ ৭১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপি হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর বাইরে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অবলোপনের মাধ্যমে ব্যাংকের হিসাবের খাতা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে আরও ৪০ হাজার ১০১ কোটি টাকা। এটি যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় প্রায় এক লাখ ৫২ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা।

আগের প্রান্তিক মার্চ পর্যন্ত অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ ছিল। ফলে গত মার্চ থেকে জুন এই তিন মাসে নতুন করে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় এক হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা; যা ওই সময় পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ ছিল। এ হিসাবে গত ছয় মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৮ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৭ সালের পুরো সময়ে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা বা ২৫ শতাংশ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।