সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যার আঁধার আর মেঘলা আকাশ মিলে অন্ধকারকে আরও গাঢ় অন্ধকার করে তুলেছে। ঠিক যেন অমাবস্যার গভীর রাতের মতো।

মুষলধারে ক্লান্তিহীন ভাবে বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে। আচ্ছা, আকাশ এত কাঁদে কেন? আকাশের কি খুব দুঃখ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে খুব ইচ্ছে করে বৃষ্টির। কিন্তু কে দিবে তার মনের ভিতর উদয় হওয়া এই প্রশ্নের উত্তর? তাই, উত্তরগুলো পায় না।
প্রশ্নগুলো প্রশ্ন হয়েই ঘুরপাক খেতে থাকে মস্তিষ্কের দেয়াল জুড়ে। এরকম সময়গুলোতে বৃষ্টি অসহায় হয়ে এলোমেলো ভাবনায় ডুবিয়ে দেয় নিজেকে।

বৃষ্টির মনটা আজ একদমই ভালো লাগছে না। কিন্তু এই মন খারাপের কারণও খুঁজে পাচ্ছে না। ওর তো কষ্টের অনুভূতি থাকার কথা নয়! বৃষ্টি তো এখন অনুভূতিহীন মানুষ! তাহলে কষ্ট হচ্ছে কেন?

আজ তনুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল! এই আনন্দের দিনে ওর মন তো খারাপ হওয়ার কথা না। তবে? রক্ত মাংসের শরীরটায় এখনো কি অনুভূতি নামক শব্দটা আচমকা জাগ্রত হয়? তা না হলে আজ এমন হবে কেন? কেন শরীরটা অবশ হয়ে আসছে, বুকের ভিতরটা জ্বলছে কেন এমন বিষাক্ত যন্ত্রণায়!

বৃষ্টির পাঁচ বছরের ছোট তনু। তনু দেখতে সুন্দর, লম্বায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি। গায়ের রঙ উজ্জ্বল ফর্সা। মনোবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করছে। অনেক বুদ্ধিমতীও। আজ ওর বিয়ের তারিখ ঠিক হলো। ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে বলেই কী বৃষ্টির মন খারাপ? কিন্তু তা হবে কেন? বোনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল, এটা তো অনেক আনন্দের! কিন্তু বৃষ্টির মন তবুও খারাপ। তবে কি স্বার্থপরতা ওকে গ্রাস করতে চাচ্ছে? ছিঃ ছিঃ! তাই বা কেন হবে?
বৃষ্টি তো স্বার্থপর হতে পারে না। কিছুতেই এতটা ছোট হতে পারে না ওর মন।

সন্ধ্যা নামার কিছু আগেই পাত্রপক্ষ চলে গেছে। তনুকে সোনার আংটি পরিয়ে বিয়ের দিন ঠিক করে গেছে ওরা। ছয়জন এসেছিল। ছেলের অফিসে জরুরী কাজ থাকায় ছেলে আসেনি আজ। তবে কয়েক দিন আগে মায়ের সাথে এসে দেখে গিয়েছিল তনুকে। প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল মা-ছেলে দুজনেরই। পছন্দ হবে নাইবা কেন? তনুর মায়াবী চেহারা দেখে কেউ অপছন্দ করতেই পারবে না। তনু তো বৃষ্টির আদুরে লক্ষ্মী একটা বোন।

সন্ধ্যার পর থেকেই বৃষ্টি ব্যলকনিতে বৃষ্টি দেখছে আনমনে। খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে বৃষ্টির ফোঁটা। কিন্তু বৃষ্টির ছুঁয়ে দেখা হয় না বৃষ্টির ফোঁটা। হুইল চেয়ারে বসে হাত বাড়ানো যায় না। হাত পৌঁছায় না বৃষ্টির ফোঁটা বরাবর।

ওর চোখে ভাসে শুধু এমনই আরেক বৃষ্টি ভেজা দিনের কথা…

পাঁচ বছর আগে এক দুপুরে, ঠিক এমন গাঢ় মেঘে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। এমনই মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছিল। বৃষ্টি তখন ওর মাকে রান্নাঘরে কাজে সাহায্য করছিল। ওর বাবা খাওয়ার সময়ের ব্যাপারে খুব কড়া স্বভাবের। দুপুর ঠিক দুইটায় টেবিলে তার দুপুরের খাবার চাই-ই চাই। তাই, বৃষ্টির মা এই বিষয়ে খুব সতর্ক থাকে।
বৃষ্টির দিন বলে সেদিন ওদের দুপুরের খাবারের জন্য রান্না হচ্ছিল খিচুড়ি, মাছ ভাজা, বেগুন ভাজা সাথে আমের টক-মিষ্টি আচার, সালাদ, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ।
খিচুড়ি রান্না তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল। মাছ ভাজাটাও শেষ। খাওয়ার আগের মুহুর্তে শুধু বেগুন ভাজা হবে।
বৃষ্টি সালাদের জন্য শসা,টমেটো আর গাজর কুচি করছিল।ঠিক তখনই তনু এসে বলল,

–আপু, চল ছাদে যাই। কী দারুণ বৃষ্টি হচ্ছে!তুই একটু তোর জলেই না হয় ভিজবি!

বলেই হাসে তনু। বৃষ্টিতে ভিজে গোসল করতে বৃষ্টিরও খুব ভালো লাগে। বৃষ্টির ঠান্ডা ফোঁটাগুলো শরীরে অদ্ভুত এক ভালোলাগা জাগিয়ে তোলে।

“মা, সালাদ কাটা হয়ে গেছে। আমি আর তনু তাহলে বৃষ্টিতে গোসল করে আসি। এর মধ্যে বাবাকেও গোসল করে নিতে বলো। তুমিও গোসল করে নাও।এরপর একসাথে সবাই খাব।”– সালাদের প্লেটটা রান্নাঘরেই প্লাস্টিকের ঢাকনি দিয়ে ঢেকে রাখতে রাখতে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি দ্রুততায় কথাগুলো বলল বৃষ্টি।

” আচ্ছা, যা। তবে সাবধানে ভিজিস। বিদ্যুৎ চমকালে চলে আসিস। আর খুব বেশিক্ষণ ভিজিস না, ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।”

মায়ের কথা শুনতে শুনতে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দুই বোন দোতলা য় ওদের বাসার দরজা পেরিয়ে তিনতলার ছাদের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

তখনও অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে বড় বড় ফোটায়। সিঁড়ির বন্ধ দরজা খুলে খোলা ছাদের মাঝখানে দাঁড়ায় বৃষ্টি আর তনু। কয়েক সেকেন্ডেই ভিজে যায় দুজনের পুরো শরীর। দুজনেই দুই হাত প্রসারিত করে মনের আনন্দে ভিজতে থাকে বৃষ্টিতে।

ওদের আশেপাশের ছাদেগুলোতেও দু’একজন মানুষকেও ভিজতে দেখা যায়। বৃষ্টিতে ভিজিতে ভিজতে দুই বোন টুকটাক কথা বলে, অকারণেই হেসে লুটিয়ে পড়ে।নির্মল আনন্দ ওদেরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।

বেশ কিছু সময় বৃষ্টিতে ভেজার পর বৃষ্টি তনুকে বলে,

–চল, বাসায় যাই। অনেক ভিজলাম। ঠান্ডা লেগে যাবে। আর মাও বকবে।

–আর একটু আপু। তুই না হয় যা,আমি একটু পরেই আসছি।

–আচ্ছা, তবে আমি যাই। তাড়াতাড়ি চলে আয়। বেশি দেরি করিস না কিন্তু!

বলেই বৃষ্টি সিঁড়ি দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে নামতে থাকে। ভেজা শরীরের পানিগুলো সিঁড়িটাকেও ভিজিয়ে দিচ্ছিল। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে একটু তাড়াহুড়ো করেই নামছিল বৃষ্টি। আর তখনই হঠাৎ টাইলসের সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে যায় বৃষ্টি। তিন তলার সিঁড়ি থেকে একেবারে গড়িয়ে দোতলায় এসে পড়ে।
‘মা’- শব্দের আর্তচিৎকার কারও কানে পৌঁছায় না সেই মুহুর্তে। বৃষ্টি তখনও অঝোরে ঝরেই যায়।

কিছু পড়ে যাওয়ার একটা আবছা শব্দকে উপলক্ষ করে বৃষ্টির বাবা বাসার দরজা খুলে বাইরে উঁকি দেন। আর তখনই গোঙানির আওয়াজ শুনতে পান। সিঁড়ির একটু নিচে তাকিয়ে দেখেন, তারই মায়াবতী মেয়েটা সিঁড়িতে পড়ে আছে, আর কষ্টে কাতরাচ্ছে।

তাড়াতাড়ি বৃষ্টির মাকে চিৎকার করে ডাকেন বৃষ্টির বাবা। তার চিৎকারে নিচতলা ও তিন তলার ভাড়াটিয়ারা ছুটে আসে। বৃষ্টিকে দোতলায় ওদের বাসায় নিয়ে যায় ধরাধরি করে। ব্যথায় ছটফট করতে থাকে বৃষ্টি। হাঁটুর নিচে আর গোড়ালি প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে। কি করবে,যেন বুঝে উঠতে পারে না কেউ। তাই বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় থাকে সবাই।

কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থেমে আসলে হাসপাতালে নেওয়া হয় বৃষ্টিকে। সেখানেই চিকিৎসা চলে পনেরো দিন। গোড়ালি ও হাঁটুর নিচে হাড় ভেঙে গেছে, এক্সরে রিপোর্ট-এ তাই দেখা গিয়েছিল।
এরপর পা প্লাস্টার করে বাসায় দেড় মাস ছিল। তারপরও কত চিকিৎসা, কত ঔষধ! কিন্তু কিছুতেই তেমন একটা লাভ হয়নি।
সেই থেকে বৃষ্টি পঙ্গু!
সেই বৃষ্টি ভেজা দুপুরটা ওকে একটা হুইল চেয়ার গিফট করেছে সারা জীবনের জন্য।

এসব পুরানো কথাই ভাবছিল বৃষ্টি ব্যালকনিতে বসে। এতদিন ওর জন্যই বাবা-মা তনুর বিয়ে দিতে পারছিল না। তাদের ভিতরে একটা অব্যক্ত কষ্ট! এক মেয়ের জন্য আরেক মেয়ের জীবন কি করেই বা নষ্ট করবেন ? কি করেই বা বড় মেয়ের চোখের সামনে ছোট মেয়ের সংসার গড়ে দিবেন? দীর্ঘশ্বাস আর অসহায়ত্ব নিয়েই বৃষ্টির বাবা-মা দিন কাটাচ্ছিলেন।

বৃষ্টিই কিছুদিন আগে, ওর বাবা-মাকে বুঝিয়েছে যে, সংসার, সুখ এসব ওর জন্য নয়। ওর জন্য তনুর স্বপ্ন নষ্ট হবে কেন? এই হুইল চেয়ারেই ওর জীবন কেটে যাবে। এতে ও অসুখী নয়। আল্লাহ ওর জন্য যা ভেবে রেখেছেন, তাই-ই হবে ওর জীবনে।

এরপর ওর বাবা-মা তনুর বিয়ে ঠিক করেছে। পাত্রপক্ষ জানে, তনুর বড় বোন পঙ্গু, অসহায়! কী যায় আসে তাতে তাদের? কিছুই যায় আসবে না।

নানান কথা ভাবতে ভাবতেই বৃষ্টির চোখেও অঝোরে অশ্রু ঝরে। বুকের ভিতরের কষ্ট আর চাপা অভিমান ওকে কাঁদায়। ও কাঁদে আর বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমাদের কী অদ্ভুত মিল তাই না রে? তোর নামও বৃষ্টি, আমার নামও বৃষ্টি। তোর বুকেও জমাট বাধা মেঘ, আমার বুকেও ঠিক তেমন। কষ্ট পেলে তুইও কাঁদিস, আমিও। তবে, তুই যখন ইচ্ছে তখনই কাঁদতে পারিস, আর আমাকে সবার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে হয়। এটুকুই পার্থক্য আমাদের! আজ থেকে তুই আমার বন্ধু।তোর একটা নাম দিই? আজ থেকে তোর নাম ‘ঝুমবৃষ্টি।’

“বৃষ্টি, কই রে মা?”–ঝুমবৃষ্টির রিমঝিম শব্দকে ছাপিয়েও বৃষ্টির কানে ওর বাবার কথা পৌঁছায়। ” আমি ব্যালকনিতে, আসছি বাবা,–বলে সাড়া দেয় বৃষ্টি।

দুই হাতের তালু আর আঙুল দিয়ে চোখ ভালভাবে মুছে নিয়ে, হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে বৃষ্টি চলে যায় ব্যালকনি থেকে। পিছনে পড়ে থাকে গাঢ় অন্ধকার আর ঝুমবৃষ্টি!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।