নারী এবং পুরুষ উভয়ই সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক সৃষ্টি। হাত-পা-চোখ-কান-নাক-মুখ জ্ঞান- বুদ্ধি সব কিছুই এক থাকলেও মিল নেই কিছুটা শারীরিক গঠনে; আর তা হলো পুরুষের লিঙ্গ। যদিও পুরুষের লিঙ্গের কোন সমস্যা নেই, সমস্যা শুধু নারীর নিতম্ব ও স্তনে। যার জন্য তাকে সারা জনম অপদস্ত-অপমানিত-অবহেলিত নির্যাতিত-নিপীড়িত-ধর্ষিত এবং যৌন হয়রানি হতে হচ্ছে সর্বক্ষণে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সৃষ্টি তত্তে পাওয়া যায়, আদম হতে হাওয়া সৃষ্টি; অর্থাৎ পুরুষ থেকেই নারীর সৃজন। তাই এখানে পুরুষের প্রাধান্য বেশি। হূমায়ূন আজাদ তাঁর, ‘নারী’ গ্রন্থে লিখেছেন, নারীর এ ‘নারী’ নাম পুরুষেরই রাখা বা পুরুষ কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া নাম। আর এ নামের গুনে ঝালকাঠির কলেজ ছাত্রী বেনজির জাহান মুক্তাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গাজীপুরের কলেজ ছাত্রী শারমিন আক্তার লিজার প্রাণ গেল ছুরিকাঘাতে, প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায়। ঢাকার পাঁচ বছরের শিশু ফারিয়া আক্তার দোলা, দুই বছের শিশু আয়েশা এবং নুসরাত জাহান চার বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়।

মৌলভীবাজারে এক তরুণীকে ফোনে ডেকে নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে গণধর্ষণ করা হয়। কিশোরগঞ্জের শাহীনূর আক্তার তানিয়াকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। নোয়াখালীতে স্বামী-সন্তানকে বেঁধে চার সন্তানের জননীকে গণধর্ষণ করে হত্যাচেষ্টা করা হয়। ফেনীর নুসরাত জাহান রাফি তারই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের প্রতিবাদ করায় পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তনুকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। দুবাই-দিল্লির ফ্লাইটে উড়ন্ত বিমানের মধ্যেই ভোর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় এক নারী যাত্রীর বুকে হাত দেয় পাশে বসা এক নারীদস্যু। কিছুক্ষণ পরে টের পেয়ে চিৎকার করে ওই নারী। তার চিৎকারে সারা দিয়ে ১৭ জন মহিলা একসঙ্গে হয়ে ওই পুরুষের গণধোলাই দিয়ে প্রতিবাদ জানায়। আকাশ পথেও নারী আতংকে, ওখানেও আছে যম।

আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক খোলা মুক্ত মনের মানুষ, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ার লক্ষ্যে যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত এবং সেই বিদ্যাপীঠের মানুষ গড়ার কারিগর যিনি ‘ব্রতচারী’ শিক্ষক, রাজশাহী মহানগর টেকনিক্যাল এন্ড বিএম ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ জহরুল আলম রিপনের হাতে ধর্ষিত হয় তার এক সহকর্মী শিক্ষিকা এবং ছাত্রী। আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহফুজুর রশীদ ফেরদৌসের হাতে পাঁচ ছাত্রী যৌন হয়রানি ও ধর্ষিত হয়। টাঙ্গাইলের সাত বছরের শিশু ধর্ষিত হয় শিক্ষক আবু তালেবের হাতে। গাইবান্ধায় ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে সুন্দরগঞ্জ মহিলা ডিগ্রী কলেজের সহকারী অধ্যাপক অশোক কুমার সরকার। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষক পরিমল জয়ধর ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। রাজধানীর মিরপুরের হলি ক্রিসেন্ট স্কুলের শিক্ষক মিনহাজ উদ্দিন প্লে গ্রুপের এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। যৌন নিপীড়নের বিচার চেয়ে চোখে কালো কাপড় বেঁধে অবস্থান ধর্মঘট করে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুই ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান মোঃ আক্কাস আলীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্তের দাবি জানায় তারা। বিদ্যাপীঠের মতো একটি আদর্শ স্থানে এ সব কুলাঙ্গারের জায়গা হয় কি করে তা ভেবে পাই না!

অহিংস ধর্মের সহিংস কর্মকাণ্ড নিয়ে মিয়ানমারের মন রাজ্যে বৌদ্ধ ভিক্ষু সেজে কয়েকশত কিশোরীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলে ‘খুনতান’ নামে এক ধর্ষক। নিজেকে পরবর্তী বুদ্ধ দাবি করে যুবতীদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে তাদের কুমারিত্ব নষ্ট করে। শিশুদের ওপর যৌন আচরণে জড়িত সাবেক ৩১ যাজককে অভিযুক্ত করেছে আমেরিকার ওয়াশিংটনের ক্যাথলিক ডাইওসিস বা প্রধান ধর্মযাযকের গীর্জা। গত ৭০ বছর ধরে এ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল তারা। পেনসিলভেনিয়ায় ৩শ’র বেশি যাজকের বিরুদ্ধে শিশু যৌন নিপীড়নের অভিযোগ প্রকাশ পায়। যশোরে মন্দিরের পুরোহিত প্রকাশ ব্যানার্জি সাড়ে ৯ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করে, চকলেটের প্রলোভন দেখিয়ে মন্দিরের ভেতরে একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে। ভারতের হরিয়ানার ফতেহাবাদের বাবা বালকনাথ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বাবা অমরপুরি ১২০ জন নারীকে ধর্ষণ করে। নিজের আশ্রমে একাধিক নারী ভক্তকে যৌন নির্যাতন করত স্বঘোষিত ধর্মগুরু ভারতের হরিয়ানার রামরহিম। বৌদ্ধ ভিক্ষু, ধর্মযাজক, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত সারা জনম ধর্মের বুলি আউড়িয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলে, তাদের কাছেও নারী নিরাপদ নয়। তারা নারীর নরম শরীর শুধু চেখেই দেখেনি, হায়েনার দাঁতগুলো দিয়ে কামরে খেয়েছে তৃপ্তিসহকারে!

ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করে জনম ভরে যাদের নীতি শিক্ষা দেয়াই কাজ, সেই মাদ্রাসার শিক্ষক, চট্টগ্রামে এক মাদ্রাসার পরিচালক, মোহাম্মদ আব্দুল্লার হাতে নয় বছরের শিশু ধর্ষিত হয়। ৬০ বছরের বৃদ্ধ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের হাতে ধর্ষিত হয় পিরোজপুরে নয় বছরের একটি কন্যা শিশু। মসজিদের ইমামের হাতে আট বছরের একটি শিশু ধর্ষিত হয় সিলেট জকিগঞ্জে। ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আব্দুল আমির তিন শিক্ষার্থীকে যৌন-নির্যাতন করে। মাদ্রাসার শিক্ষক বারিক হুজুর কর্তৃক ১৪ বছরের কিশোরী ধর্ষিত হয়। আনসার আলী ও তার ভাতিজি শরীফুলের হাতে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী ধর্ষিত হয়ে কন্যা সন্তানের মা হয় টাঙ্গাইলে। আইনের রক্ষক হলেও নারী ভক্ষণ করতে ভোলেনি নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইনে কর্মরত কনস্টেবল মৃদুল মিয়া। সে তার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এক শিক্ষার্থীকে ঘর থেকে অস্ত্রের মুখে তুলে নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে তাকে তারা পালাক্রমে ধর্ষণ করে। ঢাকা- রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার ওসি ও দুই এসআইসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অপহরণ, ধর্ষণ এবং ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগ ওঠে। নোয়াখালীর এক ইউপি চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন বিচারপ্রার্থী এক নারীকে রাতভর ইউপি কার্যালয়ে আটক রেখে ধর্ষণ করে, এরাই নাকি সমাজপতি! ধিক্কার জানাই এমন সমাজের।

জন্ম নেয়ার কিছু দিনের মধ্যেই বাছুর গরুটি তার মা’র গায়ের উপর লাফিয়ে ওঠে, সময়ে মা-সন্তানই তাদের যৌনতা মিটিয়ে থাকে; এটা হলো পশুর স্বভাব বা ধর্ম। মানুষ এখানে ব্যতিক্রম, কিন্তু না, আজ আমরা মনুষ্যত্বের অবক্ষয়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। আজ মনুষ্যত্ব এবং পশুত্ব গুলিয়ে গেছে। মনুষ্যত্বের কোনো সূচকেই আর মাপা যাচ্ছে না আদম প্রাণীকে। পশুত্বের সূচক ব্যবহার করতে হচ্ছে পৃথিবীতে। কেননা, পৃথিবী এতটাই নিষ্ঠুর যে, জন্মদাতা পিতার কাছেও নারী নিরাপদ নয়! যদিও দোষ পৃথিবীর নয়, পৃথিবীতে বাস করা কিছু কুলাঙ্গারের! এজন্য কিছু ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে চলেছে। যেমন, ভারতে মিত্তর তরম নামের এক ধর্ষক বাবা কয়েক মাস ধরে তার মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, মেয়েটি আংশিক অন্ধ ছিল। নারায়ণগঞ্জে বাবার হাতে ১১ বছরের কন্যা শিশু ধর্ষিত হয়েছে। ঢাকার সাহেদুল্লাহ নামের এক ধর্ষণকারী নিজের কন্যা শিশুকে ধর্ষণ করে একাধিকবার। কক্সবাজারের মহেশখালীতে ১৪ বছের কন্যা সন্তানকে বিয়ে দিলেও জামাইয়ের ঘরে না তুলে দিয়ে বাবা নিজেই তার মেয়েকে একাধিকবার ধর্ষণ করে। একটি নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে যৌনতা করাই হলো ধর্ষণ। নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মতি ছাড়া যৌনতায় তৃপ্তি পায় না সাধারণ মানুষ। আর ধর্ষকের চাহিদা বিপরীত। ধর্ষণের যন্ত্রনায় শিশুটি যত জোরে চিৎকার করে ধর্ষক ততটাই তৃপ্তি অনুভব করে। ধর্ষিতার চিৎকার যেন রুমের বাইরে না যায় এজন্য উচ্চ স্বরে সাউন্ড বক্সে গান বাজিয়ে ধর্ষণ করে। পৃথিবীতে মানুষই মুখ্য, মুখ্য মানুষের দ্বারায় মানুষের কল্যাণ তথা পৃথিবীর কল্যাণ। কল্যাণের ব্যত্তয় ঘটলে বা ঘটালে তার পৃথিবীতে থাকার কোনো অধিকার নেই। যেমন হিংস্র পশুগুলো গহীন জঙ্গলে থাকে লোকালয়ে তাদের কোন স্থান নেই। তদ্রুপ জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত এসব পুরুষের শেষ ‘টিকা’ দেয়াই শ্রেয়।

একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, “২০১৮ সালে ধর্ষণসহ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৪৩৩ জন শিশু। এর মধ্যে শুধু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩৫৬ জন। যার মধ্যে ধর্ষণজনিত নির্যাতনের মারা গেছে ২২ জন শিশু। আর যৌন নির্যাতন হত্যা ও শারীরিক নির্যাতনের ফলে নিহত হয়েছে ২৪৯জন শিশু”। ১৯/০৪/২০১৯ দৈনিক ‘কালের কণ্ঠ’র প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘নারী নির্যাতন হত্যার বিচার শেষ হয় না’। তাতে দেখা যায়, তদন্ত ঝুলে থাকে বছরের পর বছর, বেশির ভাগ মামলায় শাস্তি হয় না, বিচারাধীন ১,৬০,৭৫১ মামলার মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলছে ৩৬,৫০০।১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার বাধ্যবাধকতা শুধুই কাগজে-কলমে। ২৮/০৪/২০১৯ তারিখে শিরোনাম ছিল,’শিক্ষাঙ্গনে যৌন হয়রানি বিচারের নজির নগণ্য’। তাতে দেখা যায়, সাত বছরে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ-নিপীড়নের আড়াই হাজার অভিযোগ, ছয় মাসের মধ্যে বিচার শেষ হওয়ার বিধান থাকলেও বাস্তবে তেমন নজির মেলে না, তদন্তেই সীমাবদ্ধ থাকে বেশিরভাগ অভিযোগ।

হাজারো ধর্ষক-ধর্ষিতার নাম লিখার আছে, কিন্তু আর লিখতে চাই না। তো এভাবে আর কত শিশু-নারী ধর্ষিত হবে, আর কত চাঁদের মতো ফুটফুটে সুন্দর মুখগুলো এসিডে দগ্ধিত হবে। কতগুলো নিষ্পাপ প্রাণ পৃথিবী থেকে ঝরে গেলে এই লুচ্চা কামুক পুরুষের কামের জ্বালা নিবৃত্ত হবে? না, হবে না কখনো। ধর্ষক প্রভাবশালী, তার কথা পথের দুর্বাঘাসও শুনতে বাদ্ধ! বাদ্ধ না কেবল নির্যাতিত নীপিড়িত অধিকার থেকে বঞ্চিত ধর্ষিত নারীর বিলাপ পৃথিবী শুনতে! এ বিভিষিকার আর্তনাত পৃথিবী শোনে না, পৃথিবী বধির, কর্ণহীন। অতএব, হাতে নাও বল্লম নিক্ষেপ কর ঐ লুচ্চা নারীদস্যু পুরুষের বুকে। কিছুটা জ্বালা নিবৃত কর তার গোপনাঙ্গ কর্তন করে। নারী বলে হাত রেখ না কোমল, দুধে ক্যাসিয়াম, তাতে হাড় করে শক্ত; কিল-ঘুষি চর-থাপ্পর মারতে রেখ প্রস্তুত করে। দা-বটি-খুন্তা কুড়াল রেখ সর্বক্ষণ কাছে। ঘুনে ধরা জারাজীর্ণ কুষ্ঠরোগ পীড়িত মুমূর্ষু সমাজের কাছে আগেই যেও না। যেও না কোনো সমাজপতি বা প্রশাসনের কাছে, তারা সবাই পুরুষ তোমার অভিযোগ সবই হবে মিছে অথবা তাকেও দিতে হবে শরীরের ভাগ। বছরের পর বছর ধরে ঝুলতে থাকবে মামলা, এই মামলা পুরান হবে আবার নতুন করে অজস্র মামলা সামনে এসে হবে হাজির।

আনোয়ারা সৈয়দ হক তাঁর, ‘নারীর কোনো কথা নাই’ গ্রন্থে লিখেছেন,” আজ বাংলার পথঘাট নদী-নালা-ডোবা- পুকুর এমনকি বঙ্গোপসাগরেও কান পাতলে ধর্ষিত নারীদের আহাজারী ও বিলাপ শোনা যায়। কিন্তু এ দেশের পুলিশ ও প্রশাসন সে আহাজারী শুনতে পায় না। কারণ, তারা সকলেই পুরুষ। থানার পুলিশ অফিসারের শরীর সম্পূর্ণ উদোম যে পুরুষ বিচারিক আদালতে বসে আছে বিচার করার জন্য পা দোলাচ্ছে তাকে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, সেও ডিংডং, অর্থাৎ ন্যাংটো। ন্যাংটোপুটো এই পুরুষ সমাজের কাছে বিচার চেয়ে আপনার লাভ কি হবে বলুন, মা? এ দেশে অসভ্য বর্বর নারীমাংসখেকো পুরুষ সমাজের কাছে বিচার চেয়ে আপনার কিসের ফায়দা?”।

এজন্য আর ঘুমিয়ে থেকো না নারী, আঁখি মেলে দেখ জানালার ফাঁক দিয়ে নারিকেল গাছের উপরে পূর্ব দিগন্তে সূর্যটা কেমন জ্বলজ্বল করছে তোমার মুখের দিকে চেয়ে। তুমি কখন প্রতিবাদী হবে? আজ এখনই তো সেই সময়! সময়ের কাজ সময়ে করে নাও মা ও বোনেরা। ভোগবাদী এই পুরুষ শাসিত সমাজ তোমাকে কখনই দেবে না সমান অধিকার। শাসকগোষ্ঠী কখনো কাউকে শতভাগ স্বাধীনতা বা অধিকার দেয়নি। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ থেকে এমনি-এমনি যায়নি, যুদ্ধ করে তাদের তাড়িয়ে দিতে হয়েছে। পাকিস্তানিরা ১৯৫২ সালে আমাদের মাতৃ ভাষা বাংলার অধিকার এমনি-এমনি দেয়নি, শহীদের রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে নিতে হয়েছে আমাদের ভাষার অধিকার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা; বাংলার দামাল ছেলেদেরকে আদায় করে তথা ছিনিয়ে নিতে হয়েছে যুদ্ধ করে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। ভারতবর্ষের বিপ্লবী নেতা, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ইংরেজমুক্ত ভারত গড়তে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তুমি আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাকে স্বাধীনতা দেব’। এজন্য তোমাদের মধ্যে থেকে হয়তো অনেক প্রাণ ঝরে যেতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতা তোমাদের অনিবার্য; যেটা তোমাদের উত্তরসুরিগণ আজীবন ভোগ করতে পারবে। যেমনটা আমরা বাঙালি আজ ভোগ করছি স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা।

এজন্য তোমাকেও ছিনিয়ে নিতে হবে অধিকার। পায়ে আলতা আঁখিতে কাজল মেখে এসো পড়ো না নর্তকীরুপে কামুক পুরুষের কূটচালে। তুমি হবে বাস্তববাদী, এসো মানুষরুপে। খুলে ফেল হাতের চুড়ি, গহনা আছে যত স্বর্ণালংকার ফেলে দাও বঙ্গোপসাগরে। সোনার কাঙ্খে তুল না গোবর্জ্যের ঝুড়ি। ছুঁড়ে ফেলো খুন্তি, এক হাতে রেখ বল্লম অন্য হাতে নাও কলম খাতা। লুৎফর রহমান তার , ‘উন্নত জীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সাহিত্যহীন জীবন হচ্ছে কুকুরের জীবন’। এজন্য লিখাপড়ায় কর মনোনিবেশ, কর সাহিত্যচর্চায়। তোমরা আজ ঘোড়াও কলের চাকা, নাও তোমরা বিমান-বাস-ট্রাক-ট্রেন-লঞ্চের চাবি হাতে। ঘুমটা দিয়ে আর থেকো না বসে, উচ্চস্বরে গাও সাম্যের গান, নিচু কণ্ঠে আর বলো না কথা ভনিতা করে। তোমার জন্ম হয়নি স্বামী নামক আ-স্বামীর হাতে নির্যাতিত হবার জন্যে। তোমার জন্ম হয়নি সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে ছয় দিন মার খেয়ে, একদিন নরম গালের উপর একটি চুম্বন বসিয়ে দিলে; তোমার সব ভুলে যাবার জন্যে। না, তুমি ভুলে যেতে পার না, পার না তুমি ক্ষমা করতে, করতে হবে প্রতিবাদ। আত্মসম্মানের দিকে চেয়ে চেপে যেতে পার না, মুখোশ উন্মোচন করে দিতে হবে সেই সব নারীদস্যু রাক্ষসের। নারীর নরম মাংসখেকো জীবজন্তু বড় বড় দাঁতয়ালা শুকরগুলো হয়তো পাবে না তোমার প্রতিবাদের মিছিলে। কিন্তু পাবে অসংখ্য ছোট-বড় স্নেহ ভালোবাসার ভাই, পাবে পিতৃতুল্য অসংখ্য অভিভাবক। এজন্য প্রতিবাদের শুরুটা কিন্তু তোমাকেই করতে হবে আগে।

আজ কোথায় নারী নিরাপদ, স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে, হয় সহপাঠী নয় সহকর্মী নয় শিক্ষকের দ্বারায় যৌন নির্যাতিত নারী। যেকোনো অফিস-আদালতের পুরুষ বস সকাল-সাঁঝে একটু টোকা তো মারেই। চাকরি নিতে গেলে ও পদোন্নতি পেতে গেলে এবং অফিসে দেরিতে পৌঁছলে দাও নারীর শরীরের ভাগ। মডেল-অভিনয় করতে গেলে প্রযোযোগ-পরিচালকের দাও শরীরের ভাগ। বাসাবাড়ি বিপনী-বিতান বাস-ট্রাক-ট্রেন-লঞ্চ-সিএনজি-অটোরিকশা-বিমান অফিস-আদালত রাস্তাঘাটে চলতে গেলে, পুরুষের হাত নারীর শরীরে পড়েনি এমন অভিজ্ঞতার নারী বিরল! সুযোগ পেলে এ হাত ঘষবে তার নিতম্বে, স্তনে, পাছায়, পা থেকে মাথা পর্যন্ত শরীরের যে কোন স্থানে। এ হাত কোনো সাধারণ হাত নয়, এ হাত হিংস্র হায়েনার থাবার হাত, এ হাত রাক্ষসের কামনার হাত। সামনের সিটে বসা নারী যাত্রীর গায়ে ঘষে দেয় এ হাত, পিছনের সিটের কামুক পুরুষ। গাড়িতে যদি ভীড় থাকে, তো নারী দাঁড়িয়ে থাকলে সেখানে গিয়ে কামুক পুরুষগুলো নারীর পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে। আর বগলের সঙ্গে নাক লাগিয়ে সুঁকতে থাকবে বিশ্রী গন্ধ, এ যেন নিশিতে হাসনাহেনার সুবাস ছড়িয়েছে।

সাধারনত, একটি পুরুষ যদি একটি নারীর দিকে তাকায়, তো পুরুষের দৃষ্টি নারীর শরীরের কোন স্থানে গিয়ে পড়ল; ওই নারী কিন্তু টের পায়। তো এই নির্লজ্জ পুরুষ নারীর বুকের দিকে লোলুপদৃষ্টি দিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে, গালের মধ্যে মশা-মাছি বা মাকড়সা যদি বাসাও বাঁধে, তবুও টের পায় না। এ যেন ভিনগ্রহের কোনো প্রাণী এসেছে জীবনে কখনো দেখেনি, তার বাসা-বাড়িতেও নেই। এই ঘটনাগুলো সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার আগেই ঘটে থাকে। আর যদি তিমির রাত্রে মানসিক ভারসাম্যহীন, সমাজ যাকে নাম দিয়েছে ‘পাগলী’ বলে। এই পাগলীও যদি হাট-বাজার রাস্তাঘাট ফুটপাতে পড়ে থাকে বিশ্রী গন্ধ বিজড়িত দেহ নিয়ে; তো তার কাছে গিয়েও লুচ্চা পুরুষ তার লালসা বা কামের জ্বালা মিটিয়ে থাকে। তখন পাগলীর শরীর দিয়ে বকুল ফুলের গাঢ় মিষ্ট ঘ্রাণ ছড়ায়। তাকে গর্ভপাত ঘটায় দশ মাস দশ দিন পরে রাস্তার ধারে। এই নিষ্পাপ সন্তানের নামও সমাজ দিয়েছে ‘জারজ’ বলে। আর যদি সুশ্রী-সুদর্শন কোনো নারী রাত্রে বাসা থেকে বের হলো কি ওখানেই শেষ! বড়-বড় দাঁতয়ালা শুকরগুলো মাংস খেয়ে নারীর কঙ্কাল ফেলে রেখে যাবে। শোকে ভোরের পাখিরা থাকবে নীরব-নিস্তদ্ধ, বাতাস হয়ে যাবে ভারি। এজন্য অলিখিত কারফিউ জারি করা আছে নারীকুলের উপর। এত বড় কুকর্ম করেও সমাজসহ বউয়ের কাছে গিয়ে সতীত্বের বড় বুলি ছাড়ে লুচ্চা পুরুষ।

আজ কোথায় নারীর স্বাধীনতা, তার মাতৃত্বের বড় অহংকার তথা জরায়ুর স্বাধীনতাও কেড়ে নেয়া হয়েছে, সেখানে কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে পারে না। কথাবার্তায় চলনে-বলনে শিক্ষা-দীক্ষায় আচার-আচরণে মানে-সম্মানে সর্বক্ষেত্রেই যেমন নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ। তেমনি কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি বেতন বৈষম্যও ব্যাপক। সব কিছু থেকে তাকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে কেন? তারা তো পুরুষেরই মা-বোন। নারীর প্রতি এমন আচরণে কি পুরুষের মূর্খতার পরিচয় বহণ করে না? কেননা, নারী-পুরুষ-হিজড়া সবই নারীর জঠরে ধারনকৃত, নারী ছাড়া কোনো মানুষের কি জন্ম হওয়া সম্ভব? তার মানে কি গাছ থাকবে না, কিন্তু ফল খেতে হবে? ‘মা’ বলে ডাকটা খুব ভালো লাগে, মায়ের মুখের ‘খোকা’ ডাকও শুনতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু এই মায়ের যখন জন্ম হয়, তখন পুরুষের এত বমি চাপে কেন?

একটি নারী সারা জীবন ভরে সংসার করবে যার সঙ্গে, সেই বরটুকুও নিতে পারে না তার পছন্দ মতো। সেখানেও পুরুষ কর্তৃক নির্ধারিত হবে কার সঙ্গে সে সংসার করবে আর করবে না। ‘দ্য ট্রাকিস্কি কালাইদঝি’ হলো পূর্ব ইউরোপের এক প্রাচীন জনগোষ্ঠীর নাম। গোঁড়া খ্রিষ্টান এই জনজাতিরা রোমা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। মধ্য বুলগেরিয়ার স্টারা জাগোরা। প্রতি বছর বসন্তের শুরুতে সেখানে একটি মেলার আয়োজন করা হয়, আসলে মেলা নয়, বউ কেনা-বেচার হাট। এ হাটে বাবারা তাদের পছন্দের ছেলেদের হাতে মেয়েকে বিক্রি করে, যে ছেলে যত বেশি দাম হাঁকবে সেই ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে জামাই করে নেবে। তাতে মেয়ের পছন্দের কোনো তোয়াক্কা করা হয় না, কালা-ধলা লম্বা-খাটো, মেয়ের সঙ্গে মানায় কি মানায় না, তার কোনো কিছুরই বাছ-বিচার নেই। এতে মেয়েদের প্রচুর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বাবারা এমন নিষ্ঠুর অবিচার চালিয়ে যাচ্ছে। তরুণী ও কুমারী হলে, অর্থাৎ ১৩ থেকে ২০ বছরের মেয়েদের চাহিদা বেশি, দামও চড়া। বয়স বাড়লে দরও কমে।

বিয়ের আগে বাবার পছন্দে এবং বিয়ের পরে স্বামীর পছন্দে নারীর পোশাক পরিধান করতে হয়। সংসারে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হলে তার ওপর অধিকার বঞ্চিতের সাঁড়াশি অভিযান চলে। কোথায় যাবে, কখন যাবে, কেন যাবে। কার সাথে কথা বলবে কি বলবে না বা কতক্ষণ বলবে ইত্যাদি সব কিছুই পুরুষ কর্তৃক নির্ধারিত। কোনো একটি জাতিগোষ্ঠীকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত কোনো সমাজ-রাষ্ট্রই এগিয়ে যেতে পারে না। নারী-পুরুষের বৈষম্য যত দ্রুত কমানো যাবে তত দ্রুতই পৃথিবী এগিয়ে যাবে। কিন্তু যেকোনো বিষয়ের গভীরে পৌঁছতে আমাদের সময় লেগে যায়, এজন্য মাশুল আমাদের দিতে হয়, যেটা কাঙ্খিত না। এখনো এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে। মাছের মুন্ডু, বড় মাছ ছেলের পাতে দেয়া হয়। এ-জন্য যে, ছেলে কামাই-রোজগার করে খাওয়াবে সবার। এই কন্যা স্বামীর ঘরে গেলেও স্বামীর সংসারে সবার খাবার শেষে খাবে ছোট মাছটুকু, যদি অতিথি এসে পড়ে তবে সেটুকুও হয়তো আর জুটবে না। কাঁচা মরিচ ভেঙ্গে হয়তো ভাত পেলেও পেতে পারে। রান্নার আইটেমগুলোও পুরুষ কর্তৃক নির্ধারিত, আর নারী নাকে-মুখে কড়াইয়ের কালি মেখে নিজ হাতে রান্না করেও আহারে সে বঞ্চিত, ভোগে পুষ্টিহীনতায়। রান্নার স্বাদে ব্যতিক্রম হলে এবং পান থেকে চুন খসলেই আছে শারীরিক নির্যাতন। সাধারণত গ্রাম-গঞ্জে দেখি বেশি, এখনো স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতিত হতে এবং স্বামীরা স্ত্রীকে পিটিয়ে তাদের বাহাদুরি বা সে যে পুরুষ তা জানান দেয়। আর স্ত্রী যদি কখনো তার প্রতিবাদ করতে গেল তো আশে-পাশের বাড়ির অনেক মহিলারা এসে হাজির হয়ে বলে, স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেস্ত; সোনার আংটি বাঁকাও ভালো, এজন্য স্বামীকে কিছু বলা যাবে না। বয়স্ক নারীদের এই অজ্ঞতা দূর করতে হবে। এ সকল নারীই নারী মুক্তির প্রতিবন্ধকতায় ভূমিকা রাখছে।

আমরা আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। অতএব, আমাদের আচার-আচরণও সেরা জীবের মতোই হওয়া উচিত। উচিত নারী-পুরুষ-হিজরা বিভেদ ভুলে গিয়ে মানুষের পরিচয়ে মানুষকে নিয়ে পৃথিবীকে আরো সুন্দর করে সাজানো। কথিত সভ্যসমাজ যেন নারীকে হেয় পতিপন্ন না করে, না জানায় ধিক্কার সেই ধর্ষিতা নারীর। যে আত্মহত্যা না করে করেছে প্রতিবাদ, নতুন করে বাঁচতে। এই সেই জয়ীতা নারী। পাবে সংবর্ধনা, প্রেরণা যোগাতে। মধুময় সুন্দর এই ধরণীর আলো-বাতাস সুখ-দুঃখ কোন কিছু থেকেই যেন কাউকে বঞ্চিত হতে না হয়। কীটপতঙ্গ পশু-পাখি গাছ-পাতা তরু-লতা আকাশ- বাতাস পাহাড়-পর্বত নদী-নালা-খাল-বিল- ঝিল-পুকুর রাস্ত-ঘাট সব কিছু নিয়েই পৃথিবী তার ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। কোনো একটি না থাকলে পৃথিবী থাকবে না। কেননা, এগুলোর একটির সঙ্গে অন্যটির যোগসুত্র আছে। তো আমরা স্রষ্টার সৃষ্টি সেরা জীব, বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন জ্ঞানী মানুষ হয়ে কেন পারব না স্রষ্টার সৃষ্টি তথা প্রকৃতির দানকে নিয়ে ভাগাভাগি করে চলতে? আমরা কি আমাদের মর্তভূমিকে কল্যাণের আশ্রয়স্থলরুপে গড়ে তুলতে পারব না? নিশ্চয় পারব এবং এই ব্রতই প্রতিটা মানুষের হৃদয়ে লালন করব, মানবো সে ‘নারী’ তো পূর্ণাঙ্গ ‘মানুষ’।

লেখক: লাইব্রেরীয়ান, কমিউনিটি লাইব্রেরী, কুষ্টিয়া।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।