মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কর্তৃপক্ষ সবসময় সচেষ্ট কিন্ত তবু মানসম্মত শিক্ষা আশানুরূপ নিশ্চিত হচ্ছে না। নিশ্চিত না হওয়ার কারণ কি? আসল কারণ হচ্ছে একটাই আমাদের কর্তৃপক্ষ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার নিশ্চিত না হওয়ার পিছনে যে প্রধান সমস্যাগুলো রয়েছে সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে দৃষ্টি দিচ্ছে সাধারণ বিষয়গুলো নিয়ে।

এই প্রধান সমস্যাগুলোর সমাধান না করলে অন্যান্য যত পদক্ষেপ নেয়া হোক না কেন কোনদিন মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। আমাদের দেশের সম্মানিত কিছু নীতিনির্ধারক মহোদয়গণ কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর উদাহরণ দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদেরকে এমনভাবে তুলোধনা করেন যেন এই সবকিছুর জন্য একমাত্র প্রাথমিক শিক্ষকরাই দায়ী। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষকরা কি মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত না হওয়ার জন্য একমাত্র দায়ী?

ভেবে দেখুনতো কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে কোন পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে,তাদের পড়াশুনার পিছনে তাদের পিতা-মাতা কত সচেতন,তাদের পড়াশনার জন্য কত টাকা খরচ করা হয়? বিপরীত দিক দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর কথা চিন্তা করুন তো,এখানে কোন পরিবারের সন্তানরা পড়াশুনা করে,এখানকার শিক্ষার্থীদের পিতা-মাতা তাদের পিছনে কত টাকা খরচ করেন? আপনি সহজে উত্তর পেয়ে যাবেন। কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকবৃন্দ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী এবং সচেতন। তারা তাদের সন্তানদের পড়াশুনার জন্য গৃহ শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি নিজেরাও সন্তানদের পড়াশুনার বিষয়টি দেখভাল করেন।

অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের অভিভাবকবৃন্দ অধিকাংশই গরীব,অসচেতন এবং নিরক্ষর।অনেক অভিভাবক সন্তানদের স্কুলে পাঠান শুধু উপবৃত্তি পাওয়ার আশায়,আবার অনেক অভিভাবক এটাই জানেন না যে তাদের সন্তান কোন শ্রেণিতে পড়েন? অধিকাংশ অভিভাবক কাজের মৌসুমে সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কাজে লাগিয়ে দেয়। স্কুলে যা পড়াশুনা করানো হয়,শিক্ষার্থীরা বাসায় গিয়ে সেটাও অনুশীলন করার সুযোগ পায়না।ক্লাসে গেলে প্রায় দেখা যায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কারো খাতা নেই,কারো কলম নেই। কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষার্থীদের কি এই সমস্যাগুলোয় ভুগতে হয়?

আবার প্রাইমারী স্কুলগুলোর সার্বিক অবস্থা দেখুন। ধরুন একটি প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২০০জন,শিক্ষকের সংখ্যা ৫জন। এই ৫ জন শিক্ষকের মধ্যে অবসর,বদলী ও নিয়োগজনিত সমস্যার কারণে প্রায় স্কুলে ২/১জন শিক্ষকের পদ শূন্য। ৩/৪জন শিক্ষক দিয়ে টেনেটুনে স্কুল চলছে। এই ৩/৪ জন শিক্ষক কীভাবে ২০০ জন অসচেতন পরিবার থেকে আগত শিক্ষার্থীকে মানসম্মত শিক্ষা দিবে?

একজন শিক্ষককে যদি প্রতিদিন ৮-১০টি ক্লাস নিতে হয় তাহলে সেই শিক্ষকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা কী হবে তা অনুমান করুন। আবার শিক্ষকদের যদি শুধু পাঠদান করতে হত তবুও হত কিন্তু এই শিক্ষকদের শিক্ষাদানের পাশাপাশি যত ‘আজাইরা’ কাজ আছে সব করতে হয়। অধিকাংশ স্কুলেই দপ্তরী নেই তাই শিক্ষকদের টয়লেট থেকে শুরু করে মাঠ,শ্রেণিকক্ষ,অফিসরুম পরিষ্কার করতে হয়, শিউরক্যাশ, কৃমির ট্যাবলেট খাওয়ানো, শিশু জরিপের পাশাপাশি সব অফিসিয়াল কাজ নিজেদেরকেই করতে হয়। একজন শিক্ষককে সকাল ৯টা স্কুলে উপস্থিত হতে হলে সেই শিক্ষককে অবশ্যই খাওয়া-গোসলসহ সকল কাজ শেষ করে দুরত্বভেদে ৮/৮:৩০ এর মধ্যে রওয়ানা হতে হবে। তারপরে ৯-৪:৩০ পর্যন্ত যদি ৮-১০ টি ক্লাসে পাঠদানের পাশাপাশি ঐসব আজাইরা কাজ করতে হয় তাহলে ভেবে দেখুন ঐ শিক্ষকের কি অবস্থা হয়। সেই শিক্ষক ক্লান্ত হয়ে বাসায় বিকাল ৫/৫:৩০ সময় পৌছায়। এত দীর্ঘসময় পাঠদান ও অফিসিয়াল কার্যক্রমের পর সেই ক্লান্ত শিক্ষক কোন সময়ে পরেরদিনের পাঠদানের জন্য লিসন প্লান করবেন সেই প্রশ্ন সবার কাছে রইলো?

কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কি এত দীর্ঘসময় বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে হয়? শিক্ষকরাওতো মানুষ ,তাদের মনেওতো মানসম্মত জীবনযাপন নির্বাহের স্বপ্ন থাকে। প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে তার কতটুকু তারা পাচ্ছেন? একজন শিক্ষক যখন দেখেন তার স্নাতক যোগ্যতার পাশাপাশি ডিপ্লোমা ডিগ্রী থাকা সত্বেও সে অবহেলিত ও নিম্নবেতনে ৩য় শ্রেণির কর্মচারী,অন্যদিকে এসএসসি/এইচএসসি পাশের পাশাপাশি ডিপ্লোমা ডিগ্রীধারী অন্যরা সবাই ২য় শ্রেণির কর্মকর্তা, শিক্ষকরা কম ছুটি ভোগ করার পরেও তাদেরকে ভ্যাকেশনাল কর্মচারী হিসেবে গণ্য করে আর্থিকভাবে ঠকানো হচ্ছে, সমাজে একজন কেরাণীও যখন তারচেয়ে আর্থিক ও সামাজিক দিক দিয়ে বেশী মর্যাদা ভোগ করেন, যারা কোনদিন প্রাথমিক শিক্ষক ছিলেননা বা শ্রেণিক্ষে কোনদিন পাঠদান করেননি তারা যদি সরাসরি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হয়ে শিক্ষকদের আদর্শ পাঠদানের সবক দেন তখন সেই শিক্ষক কতটুকু আন্তরিকতার সাথে পাঠদান করতে পারবেন সেই বিষয়গুলো কেউ ভেবেছেন কি?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।