বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকদের বদলি প্রথা চালু নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। সম্প্রতি পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, বেসরকারি শিক্ষকদের বদলির বিষয়টি অনেকটা এগিয়ে আছে। সরকার ২০২০ সালের মধ্যে বেসরকারি শিক্ষকদের ঐচ্ছিক বদলির ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। ২০১৯ সাল শেষ হওয়ার পথে অথচ বদলির বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন বা পরিপত্র জারির কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। প্রকৃত অবস্থা হলো এখনও বদলি নীতিমালার খসড়া তৈরির কমিটিই গঠন করা হয়নি। বিষয়টি যেন এমন দাঁড়িয়েছে, সাংবাদিক ভাইয়েরা শিক্ষকদের দাবি-দাওয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল ও দায়িত্বশীল হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে খুঁচিয়ে-খাঁচিয়ে তাদের মুখ থেকে একটা বিবৃতি বের করিয়ে আনা। যারা বিবৃতি বা আশ্বাস দেন তারাও জানেন না কবে, কিভাবে বদলির বিধান হবে বা আদৌ বদলির চিন্তা – ভাবনা সরকারের শীর্ষ মহলে আছে কি না? আসলে সব-ই চলছে ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে ঘুর্ণয়নের মতো।

‘বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিদ্যালয়সমূহ)-এর শিক্ষক ও কর্মচাররীদের বেতন-ভাতাদির সরকারি অংশ প্রদান এবং জনবল কাঠামো সম্পর্কিত নীতিমালা’-১৯৯৫ এর ১৫ নম্বর ধারায় বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন বিষয়ে উল্লেখ ছিল , ‘বেতন – ভাতাদি’র সরকারি অংশ প্রাপ্ত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত অবস্থায় প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতিক্রমে কোন শিক্ষক/কর্মচারি অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমপদে নিয়োগের জন্য আবেদন করলে তাঁকে বিভাগীয় প্রার্থীরূপে গণ্য করা হবে।’ এরপর থেকেই মূলত বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।

২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির শিক্ষা প্রশাসন অংশে বদলি সম্পর্কে বলা আছে, ‘সকল পর্যায়ের সকল ধারার সকলস্তরের এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণের চাকুরি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় বদলিযোগ্য হবে। সরকারি প্রয়োজনে এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণকে সমধারার সমস্তরের প্রতিষ্ঠানে সমপর্যায়ের পদে বদলি করা হবে। ‘ জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের নয় বছর অতিক্রান্ত হলেও অদ্যাবধি এর আলোকে শিক্ষা আইন(যদিও শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণীত হয়েছিল) কিংবা শিক্ষা সংক্রান্ত কোনো বিধি বা প্রবিধি প্রণয়ন করা হয়নি। অবশ্য বিক্ষিপ্তভাবে সরকার সময় সময় প্রয়োজন অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন বা পরিপত্র জারি করেন যা নিতান্তই এবং অনেকাংশেই সঠিক ও টেকসই ছিল না বলে পরবর্তীতে প্রতীয়মান হয়।

জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে ২০১০ সালের জনবল কাঠামো(আগস্ট ২০১২ পর্যন্ত সংশোধিত)-এর ১২ নম্বর ধারায় বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি সম্পর্কে একই কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে, ‘সরকার এমপিওভুক্ত শিক্ষক, কর্মচারিদের প্রয়োজনবোধে নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে বদলি করতে পারবে।’ এ তো গেল ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি ও জনবল কাঠামোর চিত্র। মজার বিষয় হলো, সর্বশেষ ২০১৮ সালের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালাতেও পূর্বের জনবল কাঠামোর বিদ্যমান অনুচ্ছেদটুকু প্রায় অপরিবর্তনীয়ভাবে রেখে দেয়া হয়েছে। একটি অপ্রাসঙ্গিক বাক্য বাদ দেয়া হয়েছে এবং আরেকটি প্রাসঙ্গিক বাক্য যোগ করা হয়েছে। এই হলো বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি ব্যবস্থার দালিলিক অবস্থা। শিক্ষানীতি প্রণয়নের নয়টি বছর অতিক্রান্ত হলেও কোনো কমিটি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি বিষয়ে কলম ধরেননি।

অথচ বদলি প্রথা চালু করা শিক্ষার মানোন্নয়নে অতীব জরুরী। কারণ কাঙ্ক্ষিত এসডিজি অর্জনের জন্য শিক্ষাকে কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে হবে। আর তাই শিক্ষকদের বদলির ব্যবস্থা করে শিক্ষার মানোন্নয়নে কিছুটা ভূমিকা রাখা যেতে পারে। শিক্ষার মানোন্নয়নে বা শিক্ষার গতি বাড়াতে শিক্ষকদের বদলি কেন প্রয়োজন তার একটি বিশ্লেষণ দেখা যাক।

একজন শিক্ষক তাঁর নিজ এলাকায় দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করার ফলে এলাকার সচেতন মহলের অধিকাংশই তাঁর শিক্ষার্থী হয়ে যায়। যার দরুন সমাজের কাছে তাঁর জবাবদিহিতাবোধ খুব একটা থাকে না। উপরন্তু তিনি যদি রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা আর্থিকভাবে আধিপত্যপূর্ণ হন তবে তো কথাই নেই। এমন ধরনের শিক্ষক অনেক আছেন। তাঁরা প্রধান শিক্ষক বা কমিটি কোনটাকেই তোয়াক্কা করেন না। তাঁদের কাছ থেকে কোয়ালিটি এডুকেশন আশা করা বাতুলতা মাত্র। এমনকি তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দক্ষ হলেও তাঁরা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে উৎসাহবোধ করেন না। তাঁরা অধিকাংশ সময় রাজনীতি ও সামাজিকতা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।

অপর দিকে অন্য আরেক শ্রেণির শিক্ষক আছেন যাঁরা পরিবার তথা মা-বাবা কিংবা সন্তানদের কাছ থেকে অনেক দূরে শিক্ষকতা করছেন। তাঁদের সমস্যা হলো তাঁরা ইচ্ছুক হওয়া সত্বেও শ্রেণিকক্ষের পাঠদানে মনোনিবেশ করতে পারেন না। বেতন কম বলে কাঙ্ক্ষিত সময় পরপর তাঁরা বাড়ি যেতে পারেন না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই তাঁদেরকে একটা দীর্ঘ সময় কর্মস্থলে অবস্থান করতে হয়। এতে করে এ ধরনের শিক্ষকগণ মানসিকভাবে সবসময় উদ্বিগ্নতার মাঝে থাকেন। সঙ্গতকারণেই এ শ্রেণির শিক্ষকদের কাছ থেকেও কোয়ালিটি এডুকেশন আশা করা যায় না।

আরও এক শ্রেণির শিক্ষক আছেন যারা অত্যন্ত সুকৌশলী। তাঁরা কথায় পটু কিন্তু কাজে ফাঁকিবাজ। তাঁদেরকে সর্বদা নজরদারির মধ্যে রাখতে হয় যা অনেকটা বিরক্তিকর। এবং তাঁদের ফাঁকি দেয়ার কৌশল দেখে কোনো কোনো শিক্ষক ফাঁকি দিতে উৎসাহবোধ করেন।

আবার আরও এক শ্রেণির শিক্ষক আছেন যারা নিবেদিত প্রাণ। তাঁরাই শিক্ষক সমাজের প্রকৃত প্রতিনিধি। তাঁদের কল্যাণেই গুণগত শিক্ষাব্যবস্থার অবশিষ্টাংশটুকু এখনও টিকে আছে। এ শ্রেণির শিক্ষকগণ কোনো ধরনের তদারকি বা কোনো তাগিদ ছাড়াই পেশাগত দায়িত্ববোধ থেকেই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্রতী হোন।

অন্য এক শ্রেণির শিক্ষকদের কথা না বললেই নয়। এ শ্রেণির শিক্ষকগণই শিক্ষাকে বাণিজ্যিকিকরণ করেছেন। শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বাজারজাত করে ফেলেছেন। তাঁদের জন্যই পুরো শিক্ষক জাতি আজ প্রশ্নের সম্মুখীন।

উপরের বিশ্লেষিত সকল ধরনের শিক্ষকেরই বদলি প্রয়োজন। বদলি কারো জন্য পুরস্কার হবে, কারো জন্য তিরস্কারও হবে। আবার কারো জন্য উপভোগ্য বা বৈচিত্র্যময়ও হতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বদলি তিরস্কারস্বরূপই হবার কথা। আমি বুঝে ওঠতে পারছি না বদলির জন্য আন্দোলন লাগবে কেন? কারণ বদলির ফলে লাভবান হবেন মুষ্টিমেয় শিক্ষক। শিক্ষার মানোন্নয়নের তাগিদেই তো বদলি প্রথা চালু করা উচিত। এক্ষেত্রে সরকার আন্দোলনকে বদলি প্রথা চালুর ক্ষেত্রে বোনাস কারণ হিসেবে নিতে পারে। একটি সুষ্ঠু বদলি নীতিমালা(বিদ্যমান সরকারি নীতিমালার আলোকে) জরুরীভিত্তিতে প্রণয়ন করে উপরে বর্ণিত সমস্যা সমাধানের আলোকে বদলি প্রথা চালু করলে নিঃসন্দেহে শিক্ষা ব্যবস্থায় গতি বাড়বে এবং প্রাণ ফিরে আসবে।

বদলি চার ধরনের হতে পারে। ১) পুরস্কারভিত্তিক ২) তিরস্কারভিত্তিক ৩) প্রতিযোগিতাভিত্তিক এবং ৪) প্রয়োজনভিত্তিক। প্রথম দুটোতে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে দক্ষতা ও পারফরম্যান্স বিবেচ্য হতে পারে। তৃতীয়টিতে পরীক্ষার মাধ্যমে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও পারফরম্যান্সের উম্মুক্ত ব্যবহার থাকতে পারে। সবশেষটিতে সন্তোষজনক চাকুরির পর শিক্ষকের প্রয়োজনের নিরিখে ও আবাসভূমি থেকে রিজনাবল দূরত্ব বিবেচ্য হতে পারে। আর সর্বক্ষেত্রেই রিজনাবল বাড়িভাড়া ভাতা তো থাকতেই হবে। তবে মনে রাখতে হবে জাতীয়করণই হলো শিক্ষার মানোন্নয়নের প্রকৃত উপায়।

# এম এ বাতেন ফারুকী, প্রধান শিক্ষক, সৈয়দ হাবিবুল হক উচ্চ বিদ্যালয়, বৌলাই, কিশোরগঞ্জ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।