প্রদীপ কুমার দেবনাথ;  বর্তমান বিশ্ব জ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর। জ্ঞান অর্জনের প্রধান অস্ত্র হল শিক্ষা। অন্যদিকে প্রযুক্তিতে দক্ষ হওয়ার পূর্ব শর্তও শিক্ষাই। শিক্ষা ছাড়া কোন উন্নয়ন অসম্ভব। বৈশ্বিক যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চাই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ আধুনিক শিক্ষায় তাদের জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে মেধাবী জনগোষ্ঠী তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মতো সম্ভাবনাময় একটি রাষ্ট্র। দরকার একটি শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত জনবল। আজকের শিক্ষার যে দৈন্যদশা ও সার্বিক বিপর্যয় তা মূলত মানসম্মত শিক্ষক ও শিক্ষায় আধুনিক পদ্ধতির পরিপূর্ণ ব্যবহারের অভাব।

  • শিক্ষায় সমস্ত প্রতিকূলতা ও গতি আনয়ণের ক্ষেত্রে জাতীয়করণের বিকল্প নেই। জাতিয়করণ হলেই শিক্ষায় গতি আসবে শতভাগ।

বর্তমান বাজেটে যে অতিরিক্ত বরাদ্দ তার অর্ধেক খরচ করেই জাতীয়করণ সম্ভব। শিক্ষাখাতে এবার ৬৬ হাজার ৪০১ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ২৪ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৩৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় ৮ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা।

  • প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সরকারি বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বরাদ্দ ৫ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা বেশি। বর্তমান সময়ে বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রকোপে শিক্ষা কার্যক্রম সহ প্রায় প্রতিটি সেক্টরে সাধারণ কার্যক্রম প্রায় নেই বললেই চলে। এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলবে এমন আভাসও ইতিমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিয়েছে। তাই অন্যান্য বছরের মতো প্রকল্প, প্রশিক্ষণ, ভ্রমণ, অবকাঠামো উন্নয়ন এগুলোর সুযোগ সীমিত। আর যেহতু সামাজিক দুরত্ব মানা, স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী আমাদের এ মুহুর্তে চলা উচিত তাই এ বছর প্রশিক্ষণ সহ অন্যান্য কার্যক্রম প্রায় অসম্ভব। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এবার শিক্ষক/কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের হাহাকার ঘুচাবার সুযোগ আছে। প্রয়োজন শুধু আন্তরিকতার। এবার এ বিপুল বাজেটের আংশিক খরচের মাধ্যমে জাতীয়করণ করা সম্ভব। মানসম্মত শিক্ষা ও মেধাবী জাতি গঠনে জাতীয়করণের বিকল্প নেই। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের তুলনায় শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে আমাদের অবস্থান তলানীতে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা হাস্যরসের খোরাক হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সর্বোচ্চ পর্যায়ে শিক্ষাখাতকে প্রাধান্য দেওয়া, মাধ্যমিক শিক্ষাকে গতিশীল করা, মাধ্যমিক পর্যায়ে মেধাবিকাশে প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা চালুকরণ জাতীয়করণ ছাড়া সম্ভব নয়।

বর্তমানে শিক্ষকতার পেশাটাকে মুখে মুখে সম্মানজনক পেশা বলা হলেও গ্রেড অনুপাতে বেতন, কল্যানট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডের আচরণ, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা আর সিকি উৎসবভাতা কিন্তু অন্যটা প্রমাণ করে। আমরা যে শতভাগ অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার তা কিন্তু এই বেতন ও সামান্য সুবিধা প্রমাণ করে। এই পেশার এই অবমূল্যায়ন আর সিকি সুবিধা প্রত্যক্ষ করে মেধাবীরা এ পেশায় আসতে চায়না। অন্যান্য চাকরি বঞ্চিত হলে একান্ত বাধ্য হয়ে তারা এ পেশায় আসলেও বেতন, ভাতা ও মূর্খ পরিচালনা কমটি দেখে পড়ানোর মানসিকতা পরিবর্তন করে তারা এটাকে চাকরি হিসেবে বেছে নেয় সেবা হিসেবে নয়। এটা জাতির জন্য অশনিসংকেত। অভাবগ্রস্ত শিক্ষকগণ মানসিক ভাবেও বিপদগ্রস্ত। অভাব যখন চারদিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে তখন নিদারুণ কষ্টের ভাণ্ডার থেকে সৃজনশীল কিছু পাওয়ার চিন্তাই বৃথা। তাই অতিশীঘ্র জাতীয়করণ না হলে এ শিক্ষা ব্যবস্থায় অরাজকতা বৃদ্ধি পাবে, শিক্ষায় প্রতিযোগিতা আরো কমবে এবং এসব সেক্টরে প্রচণ্ড অসন্তুষ্টি দেখা দিবে।

  • শুধু উন্নত নয় আমাদের দেশের চেয়েও অনুন্নত বেশ কয়েকটি এশিয়ান রাষ্ট্রে শিক্ষাখাতে সর্বনিম্ন জিডিপি ৩.৫০ বা ৪ শতাংশ সেখানে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হয়েও আমাদের আমাদের জিডিপি ২.০৯ শতাংশ। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আজকে মাধ্যমিক শিক্ষাকে অবহেলা করার করুণ পরিণতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য বিশ্ব বিদ্যালয়ে সুস্পষ্ট। এশিয়া মহাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশের সাথে তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান তলানীতে। পাবলিক বিশ্ব বিদ্যালয় গুলোতে মেধাহীনদের জয়জয়কার দেখা যায়। মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা ও মাদ্রাসাগুলোতে একেক প্রতিষ্ঠানের একেক চিত্র লক্ষণীয়। সরকারি কমন আদেশ ব্যতিত অন্য কার্যক্রম নিজস্ব রীতিতে হওয়ার কারণে একেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশ সুন্দর একেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম নেই বললেই চলে। সেসব প্রতিষ্ঠানে কমিটি ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সারা বছরই শিক্ষক/শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও অসহযোগিতা চরমে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ টাকা লুটপাটের বাইরে শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় শূণ্যে। বাংলাদেশের মাধ্যমিক, উচ্চ শিক্ষা ও মাদ্রাসাগুলোতে এ অবস্থাটা নিয়মিত।

হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানে পাবলিক পরীক্ষায় ফলাফল আশানুরুপ হয় আর বাকীগুলো বরাবরই নিম্নমুখী। অপরদিকে অধিকাংশ শহরের স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি, সেশন চার্জ, শিক্ষার্থীদের বেতন, তাছাড়া প্রায় প্রত্যেক শিক্ষকের ব্যাপক টউশনি থাকায় তাদের রোজগার ব্যাপক। মাসে প্রায় ১ থেকে দেড় লক্ষ উপার্জনকারী এসব শিক্ষক, প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাটা জমজমাট। এই স্বল্প কিছু শহরে আর বড় আয়ের প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর বাকী সকল প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান ও পদ্ধতিতে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। তাই সারা বাংলাদেশের মাধ্যমিক, উচ্চ শিক্ষা ও মাদ্রাসাসহ সহশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাণবন্ত করতে, আশানুরূপ ফলাফল পেতে জাতীয়করণ একান্ত প্রয়োজন। বিশাল বাজেটের আংশিক এবং প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের আয় জমা নিয়ে জাতীয়করণ করলে শিক্ষক/শিক্ষার্থী যেমন উপকৃত হবে তেমনি আমাদের শিক্ষায় আন্তজার্তিক মান ও কৌশল অবলম্বন করে বাস্তবিক প্রয়োগ সম্ভব হবে।

লেখক, প্রদীপ কুমার দেবনাথ: শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আমাদের বাণী ডট কম/১৪জুন ২০২০/ডিএ 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।