সাইফুল হক; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনিসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপলিসে শেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক জর্জ ফ্লয়েড নামের কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে শ্বাসরোধ করে বর্বরোচিতভাবে হত্যাকান্ডডের পর এই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রায় গোটা যুক্তরাষ্ট্র, তার বড় বড় শহরগুলো এখনও উত্তাল। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় প্রতিটি শহরে। ১৯৬৮সালে কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের প্রবাদপ্রতীক নেতা মার্টিন লুথার কিং এর হত্যাকান্ডের পর এত বড় প্রতিবাদ বিক্ষোভ আর দেখা যায়নি। অনেকগুলো শহরে কারফিউ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এই প্রথম অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভ ও সহিংসতা দমনে সতেেের হাজার ন্যাশনাল গার্ড নামানো হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিক্ষোভকারীদের হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন প্রয়োজনে বিক্ষোভ দমনে মিলিটারী নামানো হবে; বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে হিংস্র কুকুর লেলিয়ে দেয়া হবে। গত শতাব্দীর ৬০ দশকে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃতি দিয়ে ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন ‘লুট শুরু হলে গুলিও শুরু হবে’।

  • মার্কিন প্রেসিডেন্ট অভূতপূর্ব এই বিক্ষোভ প্রশমন না বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য শোনার পরিবর্তে প্রায় প্রতিদিনই তিনি টুইটার বা সংবাদ সম্মেলনে উস্কানীমূলক বক্তব্য দিয়ে চলেছেন, আগুনে ঘি ঢেলে দিচ্ছেন। নিজেকে ‘ল এন্ড অর্ডার’ প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়ে এই বিক্ষোভের জন্য একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগঠন ‘অ্যান্টিফা’, চরম বামপন্থী ও নৈরাজ্যবাদীদের দায়ী করছেন; আর অন্যদিকে ডেমোক্রেট দলীয়দের মদদাদানকেও উল্লেখ করছেন। তিনি এটাকে কেবল মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের বিক্ষোভ হিসেবে চিত্রিত করারও চেষ্টা করছেন। মনে করছেন শক্তি প্রয়োগে এই বিক্ষোভ দমনের মধ্যে দিয়েও আরা একবার তিনি মার্কিন শেতাঙ্গদের আধিপত্যের প্রমাণ দেবেন।

কিন্তু বর্ণবাদবিরোধী এই বিক্ষোভে কেবল কৃষ্ণাঙ্গরা নয়, এই বিক্ষোভে সামিল রয়েছেন সাদা, বাদামী, হিম্পানীকসহ বর্ণনির্বিশেষে মার্কিন নাগরিকদের প্রায় প্রতিটি অংশ। এই বিক্ষোভের সাথে সংহতি জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানীসহ ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। ভ্যাটিকান পোপ ফ্রান্সিস জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ড এবং তার প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত বিক্ষোভকে ‘বর্ণবাদের পাপের ফলাফল’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। দু’দুবারের কৃষ্ণাঙ্গ বংশোদ্ভুত সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বিক্ষোভে সহিংসতা পরিহারের আহ্বান জানিয়ে এই প্রতিবাদী আন্দোলনকে নতুন অধ্যায় এর সূচনা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। সাবেক অপর তিন মারকীন প্রেসিডেন্ট জিমি কারটার, বিল ক্লিনটন ও জর্জ বুশ চলমান বিক্ষোভ এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, তাদের প্রশংসা করেছে।

  • কেবল জর্জ ফ্লয়েডের নিষ্ঠুর হত্যাকা-ই নয়, মাত্র গত ছয় বছরেই শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে অসংখ্য কৃষ্ণাঙ্গরা নিষ্ঠুর হত্যাকানডেের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১১ বছরের কিশোর সমর রাইস থেকে শুরু করে নারীরাও রয়েছেন। কেবল কৃষ্ণাঙ্গ বলেই প্রতিবছরই মার্কিন কালো মানুষদেরকে এখনও পর্যন্ত অমানবিক নিপীড়ন-নির্যাতন আর যখন তখন হত্যাকানডেের শিকার হতে হয়। বাদ যায় না বাদামী, হিম্পানিক, ল্যাটিনো আমেরিকান ও এশীয়রাও।

চলমান বিক্ষোভের প্রত্যক্ষ কারণ জর্জ ফ্লয়েডের নৃশংস হত্যাকান্ড হলেও তা আসলে উগ্র ও হিংস্র¯্র বর্ণবা েদর বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গসহ মার্কিন জনগণের এক বড় অংশের পুঁঞ্জিভূত ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। কেবলমাত্র বর্ণের কারণে কোটি কোটি মার্কিন নাগরিকদেরকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এখনও পর্যন্ত যে বৈষম্য,নিগ্রহ আর নিপীড়ন এর শিকার হতে হচছে এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও নৈরাজ্যিক ঘটনাবলী তা থেকেই উৎসারিত। করোনা মহামারীকালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়েই কৃষ্ণাঙ্গদের স্বাস্থ্যসেবার মান শেতাঙ্গদের তুলনায় বেশ নীচে। করোনায় মৃত্যুর দিক থেকেও কৃষ্ণাঙ্গদের আনুপাতিক হারও বেশী।

  • ১৯৬৪ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য নাগরিক আইন প্রণয়ন আর ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার সংক্রান্ত আইন পাশ হবার পর নানাদিক থেকেই পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। মার্কিন জনগণ একজন কৃষ্ণাঙ্গ বাবার সন্তানকে দুই মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে। সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির বিভিন্ন স্তরেও আফ্রিকান আমেরিকানদের প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তা মার্কিন সমাজের অন্তঃস্থিত গভীর বর্ণবাদী বৈষম্য, হিংসা ও ঘৃণা দূর করতে পারেনি। কৃষাঙ্গদেরকে অপরাধী হিসেবে চিত্রিত করার প্রবণতা এখনও শক্তিশালীভাবেই বিদ্যমান। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশী ব্যবস্থা যে এখনও মারাত্মকভাবে বর্ণবাদী তা এখন গোপন কোন বিষয় নয়। শ্বেতাঙ্গ মার্কিনীদের তুলনায় কৃষাঙ্গ মার্কিনীদের পুলিশ কর্তৃক ভয়ানকভাবে নিগৃহীত ও নিহত হবার আশঙ্কা যে কয়েকগুণ বেশী বেশ কিছু গবেষণার তথ্যেও তা বেরিয়ে এসেছে। প্রতিবছর পুলিশ কর্তৃক কলো ও বাদামী মার্কিনীদের উপর যে সহস্রাধিক নিপীড়ন ও অন্যায়ভাবে বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটে তার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশের কোন বিচার বা শাস্তি হয় না।

দুনিয়াব্যাপী শোষিত-বঞ্চিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত কোন শ্রেণী, সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, লড়াই-সংগ্রাম ছাড়া কোনকালে কোন অধিকারই আদায় করতে পারেনি; নিজেদের মুক্তি অর্জন করতে পারেনি। আন্দোলন-গণবিক্ষোভ আর বিপ্লবী শ্রেণী ও রাজনৈতিক সংগ্রাম ব্যতিরেকে নির্যাতন-নিপীড়নের জোয়াল ভেঙে ফেলতে পারেনি। সমঅধিকার আর সাম্য নিয়ে নিজেদেরকে পূর্ণাঙ্গ মানুষের স্তরে উন্নীত করতে পারেনি। এটা বিশ্ব ইতিহাসের এটা এক সাধারণ অভিজ্ঞতা। আমেরিকায় ৪০০ বছরে আগে যে দাস ব্যবস্থার যাত্রা শুরু গত দুই-আড়াইশ বছর ধরে অসংখ্য প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের পথেই উনবিংশ শতাব্দীতে আনুষ্ঠানিকভাবে দাস ব্যবস্থার বিলোপ ঘটে এবং তৎপরবর্তী দেড়শ বছরে প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের পথেই আজ পর্যন্ত যেটুকু যা অর্জন। যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় এখনও পক্ষপাতদুষ্ট যে বর্ণবেষম্যমূলক অবস্থা বিদ্যমান, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানাস্তরে দৃশ্য ও অদৃশ্য বর্ণবাদের যে উপস্থিতি রাজপথে লক্ষ কোটি জনতার পিছু না হটা প্রতিবাদ-বিক্ষোভই কেবল এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারে; পদ্ধতি ও কাঠামোগত পরিবর্তনের বাস্তবভিত্তি তৈরী হতে পারে।

  • মার্কন যুক্তরাষ্ট্রে এই মুহুর্তে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার রাজপথে ; হোয়াইট হাউস, সিনেট বা কংগ্রেসের আইন সভার মধ্যে নয়। রাজপথের এই অবস্থান ও লড়াই ব্যতিরেকে স্বৈরাচারী, কর্তৃত্বপরায়ন আর ফ্যাসিবাদী শাসকদেরকে পিছু হঠতে বাধ্য করা যায় না; বিদায় দেওয়া যায় না। হোয়াইট হাউসের সামনে হাজার হাজার মিশ্রবর্ণের নিরস্ত্র আমেরিকানদের বিক্ষোভ ছাড়া প্রেসিডেন্ট ট্যাম্পকেও তো সুরক্ষিত বাংকারে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা যেত না। আর যেকোন স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলন-গণবিক্ষোভে সুযোগ সন্ধানী এক ধরনের মানুষ অপ্রয়োজনীয় ভাংচুর ও লুটপাটে অংশ নেয়। কখনও কখনও আন্দোলনে অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনাও ঘটে। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে সমগ্র আন্দোলন-বিক্ষোভকে বিচার করার কোন সুযোগ নেই। বারাক ওবামা এটাকে ” …… দশকের পর দশক ধরে ব্যর্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃত ও বৈধ হতাশার প্রকাশ” হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু অঙ্গরাজ্যে জনতার প্রতিবাদ বিক্ষোভের মুখে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা হাটু গেড়ে জনতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। অনেক জায়গায় আন্দোলনের সাথে তারা তাদের সংহতি ব্যক্ত করেছেন। ইতিমধ্যে বেশ ক’টি জরীপে উঠে এসেছে যে আমেরিকানদের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে সমর্থন করছেন, যৌক্তিক মনে করছেন। নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে। করোনা মহামারীজনীত পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের জনসমর্থন যখন তলানীতে তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মার্কিনীদের এই মনোভাব ট্রাম্পের জন্য কোন ভাল সংবাদ নয়।

  • শুরু থেকেই ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন না করে উল্টো জর্জ ফ্লয়েডের রোমহর্ষক হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে মার্কিনীদের ন্যায্য বিক্ষোভকে বর্ণবাদী অবস্থান থেকেই একদিকে উস্কানী আর অন্যদিকে বল প্রয়োগে দমন করার যে রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করছেন তার প্রধান লক্ষ কৃষনাঙ্গদের বিরুদ্ধে শেতাঙ্গ মার্কিনীদের ঘৃণা, বিদ্বেষ ও বিভাজন জাগিয়ে তোলা। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ট্রাম্পের এই কৌশল কাজে দিয়েছে। করোনা দুর্যোগে বেসামাল ট্রাম্প এখন শেতাঙ্গদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তার পারদ উপরে তুলতে পরোক্ষভাবে একটা গৃহযুদ্ধাবস্থার দিকেও দেশকে নিয়ে যেতে চাইছেন। গত প্রায় চার বছর নানাভাবে, বর্ণবিদ্বেষ থেকে অভিবাসন বিরোধী প্রভৃতি বহুমুখী তৎপরতার মধ্য দিয়ে তিনি এই বিভাজন ও মেরুকরণ আরো সংহত ও জোরদার করার চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন। কথিত গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের বুলি নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে তারা আগুন নিয়ে খেলেছে ; অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে। এখন আগুন একেবারে নিজেদের ঘরে। শান্তিপূর্ণভাবে নিরস্ত্র লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দমন করতে যেয়ে তাদের কথিত গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের মুখোশ ভালোভাবেই খসে পড়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মার্কিনীদের গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ যাবতীয় বর্ণবৈষম্য, শোষন-বঞ্চনা আর নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাজপথের উত্তাল এই গণপ্রতিরোধ। এই প্রতিরোধ লড়াই বর্ণবাদের বহুমাত্রিক প্রকাশ ও মার্কিন কর্পোরেট পুঁজির আধিপত্যকে নির্মূল করবে না সত্য, কিন্তু তা নতুন আমেরিকা তৈরীর নানা পথকে যে খানিকটা প্রশস্ত করবে- এই আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়তো অমূলক হবে না।

লেখক: সাইফুল হক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, নিউ ইস্কাটন, ঢাকা, ৪ জুন, ২০২০।

আমাদের বাণী ডট কম/০৭ জুন ২০২০/সিসিপি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।